মুমিনুল হক
মুমিনুল হক

কল্পনায় ক্রিকেট খেলেন মুমিনুল

এই চন্ডিকা হাথুরুসিংহেই তখন কোচ ছিলেন, যখন মুমিনুল হকের কাছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বলের রং হয়ে গেল শুধুই লাল। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর প্রায় চার বছর বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপে দুটি ম্যাচ খেলে করলেন ৯ আর ৫ রান। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা তাঁর জন্য পুরোপুরিই জাপানের পতাকার মতো—সাদার মধ্যে লাল।

২০১৮ সালের পর থেকে মুমিনুল শুধুই টেস্ট ক্রিকেটার আর তিন সংস্করণের ক্রিকেটে এই সংস্করণটাই বাংলাদেশ খেলে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে তাই মুমিনুল আসেন অতিথি হয়ে। টেস্ট ক্রিকেট হলে থাকেন, ওয়ানডে আর টি–টোয়েন্টির সময় সেখানেই তাঁর প্রবেশাধিকার নেই।

এমন যদি হতো মমিনুল শুধুই টেস্ট খেলছেন তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে; তাহলে একটা ব্যাপার ছিল। তেমন নয় বলেই সাদা বলের ক্রিকেটে ব্রাত্য হয়ে মুমিনুল একটা সময় হতাশার সাগরে ডুবে গিয়েছিলেন। এরপর যখন উপলব্ধি এল, টেস্ট ক্রিকেট ছাড়া তাঁর আসলেই আর কোনো ঠিকানা নেই, তখন শুরু হলো অন্য লড়াই। হঠাৎ হঠাৎ আসা লাল বলের ক্রিকেটের জন্য নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখার যুদ্ধ। এটাকেই অভ্যস্ততায় নিয়ে আসার চেষ্টা। ড্রেসিংরুমে অতিথি হবেন ঠিক আছে, কিন্তু সেটা যেন কারও কাছে আগন্তুকের মতো মনে না হয়।

মিরপুরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে গতকালের অপরাজিত ১২১ রানের ইনিংস মমিনুলের জন্য সে রকমই একটা কিছু, যা ভবিষ্যতের জন্য হতে পারে প্রাণশক্তি। ২০২১ সালের এপ্রিলে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে সেঞ্চুরির পর মাঝে ২৬ ইনিংসে দুটো ৮৮ আর ৮৪ ছাড়া বলার মতো কিছু নেই। গত ডিসেম্বরে এই মিরপুরেই ভারতের বিপক্ষে ৮৪ করার আগের ৯ ইনিংসে দুই অঙ্কে পৌঁছাতে পারেননি একবারও। মজার ব্যাপার হলো, ক্যারিয়ারে বারবার এমন প্রতিকূল স্রোতের মধ্যে পড়েও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা, দীর্ঘ বিরতি দিয়ে দিয়ে টেস্ট খেলেও ব্যাটিংটাকে শাণিত রাখার লড়াই, এসব মুমিনুল যত না ব্যবহারিকভাবে করেন, তার চেয়ে কম করেন না মনস্তাত্ত্বিকভাবেও।

মিরপুর টেস্টে কাল তৃতীয় দিন শেষে মাঠ ছাড়ার সময় হাসিখুশি মুমিনুল

গতকাল সেঞ্চুরি–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মুমিনুলের সেই মনের জানালাটাই সবাই খুলে দেখতে চাইলেন। তিনিও খুলে দিলেন অর্গল। যার সারমর্ম, যেহেতু বুঝেই গেছেন টেস্ট খেলতে নামতে হবে লম্বা বিরতি দিয়ে, তিনিও মনটাকে সেভাবেই প্রস্তুত রাখেন। মুমিনুলের কথা থেকেই শুনুন, ‘আপনি যদি এই মানসিকতা আনতে পারেন যে এক বছর পরে হোক বা পাঁচ মাস বা প্রতিদিনই হোক, যেটা হবে সেটাই আমার জন্য ভালো...। একেক জনের ক্ষেত্রে হয়তো ব্যাপারটা একেক রকম। তবে আমার জন্য এটাই ঠিক।’

শুধু টেস্ট খেলার একটা ভালো দিকও খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। তিন সংস্করণের ক্রিকেট মানে তো তিন রকমের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বসবাস। কোনটার পরিচর্যায় কত সময় দেবেন, সে নিয়ে সময়ের ভাগাভাগি। যাঁরা শুধু এক সংস্করণে খেলেন, তাঁরা সেটার ওপরই বেশি করে জোর দিতে পারেন। বলের রং বদলের সঙ্গে খেলার রং বদলের ঝামেলা আর থাকে না।

মুমিনুলের ক্ষেত্রে অনেক সময় কল্পচোখের অনুশীলনেও কাজটা অনেক এগিয়ে যায়। বাংলাদেশ টেস্ট কম খেলছে, মাঠে–নেটে সব সময় অনুশীলনের সুযোগ নেই। তবে মনের পর্দায় টেস্ট ক্রিকেটের আবহ ফুটিয়ে কল্পনায় মুমিনুল যে ড্রাইভগুলো করেন, যে বাউন্সারগুলো সামলান, খেলতে নামলে সেসবও কাজে লেগে যায় অনেক।

সব সময় টেস্ট ক্রিকেট নিয়েই ভাবেন মুমিনুল

ক্রিকেটে মনস্তত্ত্ববিদেরাও এমন অনুশীলনের পরামর্শ ক্রিকেটারদের দিয়ে থাকেন। তবে প্রতিনিয়তই মানসিক ঝড়ঝাপটা সামলে মুমিনুলই–বা এখন মনস্তত্ত্ববিদের চেয়ে কম কিসে! লম্বা বিরতিগুলোতে নিজেই নিজের মনোবিদ হয়ে কল্পচোখে দেখেন তিনি টেস্ট খেলছেন, বাউন্সারে ডাক করছেন, বাজে বলে বাউন্ডারি মারছেন, সেঞ্চুরির পর ব্যাট উঁচিয়ে ধরছেন।

মুমিনুলের বর্ণনায়, ‘তখন কিন্তু ভিজ্যুয়ালাইজেশন বা মেডিটেশন করেই নিজেকে আপনি তৈরি করতে পারেন। তখন আর এত দিন পর ক্রিকেট খেলছি, এটা মনে আসবে না। তবে এটা আমার ক্ষেত্রে হয়, আরেকজনের ক্ষেত্রে হবে কি না জানি না।’

খেলা থেকে দূরে থেকেও মুমিনুল তাই খেলার মধ্যেই থাকেন। মনের আয়নায় খেলা প্রতিটি ম্যাচে তিনিই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। বাস্তব ম্যাচে যে ব্যাটটাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে মাঠে যান, সেটা তখন হারমোনিয়াম হয়ে রানের মূর্ছনা ছড়াতে পারে।

এরপর সাদা পোশাকের মুমিনুল যখন আবারও সাদা বলের ক্রিকেটকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসবেন, মনের বাজনাতেই তিনি শুনে নেবেন, পেছন থেকে কে যেন গাইছে, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই... চিরদিন কেন পাই না...।’