বেঙ্গালুরু, পুনের পর মুম্বাই টেস্টেও হেরে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৩–০ ব্যবধানে ধবলধোলাই হয়েছে ভারত। প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে ধবলধোলাই হওয়া এই সিরিজ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে এখনো তুমুল আলোচনা চলছে ভারতীয় ক্রিকেট মহলে।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা সম্ভবত মুম্বাই টেস্টের শেষ ইনিংসে ঋষভ পন্তের আউট, যা নিয়ে অনেক বিতর্ক চলছে। পন্তের আউটের মুহূর্তটিকে ম্যাচের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ও বলা হচ্ছে।
মুম্বাইয়ে শেষ টেস্টে রোহিত শর্মার দলের ২৫ রানের হারে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকেও (বিসিসিআই) কাঠগড়ায় তোলা যায়। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ক্রিকেট বোর্ড হওয়া সত্ত্বেও যে এই অত্যাধুনিক যুগে হটস্পট প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা দেখিয়ে চলেছে বিসিসিআই। অনেকের ধারণা, ভারত হটস্পট প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পন্ত না–ও আউট হতে পারতেন। আর তিনি টিকে থাকলে ম্যাচটা ভারতই জিতত।
পন্তের আউটটি আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ৫৬ বলে ৬৪ রানে ব্যাট করছিলেন এই উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান। এজাজ প্যাটেলের করা পরের বলে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ডিফেন্স করেন তিনি। বল জমা পড়ে কিউই উইকেটকিপার টম ব্লান্ডেলের হাতে। তবে এজাজ–ব্লান্ডেলদের আউটের আবেদনে সাড়া দেননি মাঠের আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ। রিভিউ নেন কিউই অধিনায়ক টম ল্যাথাম।
ভিডিও রিপ্লেতে স্নিকো মিটার বা আলট্রা এজ দেখে মনে হয়েছে, বল পন্তের ব্যাট স্পর্শ করেছে। তবে একই সময়ে পন্তের ব্যাট প্যাডেও লেগেছে। রিপ্লে দেখানোর সময় পন্ত মাঠের দুই আম্পায়ার ইলিংওয়ার্থ ও মাইকেল গফকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তৃতীয় আম্পায়ার পল রাইফেলের নির্দেশে ইলিংওয়ার্থ সিদ্ধান্ত পাল্টে আউট ঘোষণার পর পন্তের মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর ড্রেসিংরুমে ফেরার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে অনিচ্ছাকৃত যাত্রা!
ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম (ডিআরএস) ক্রিকেটে আসার পর থেকে বিসিসিআই নিজেদের মাটিতে তা ব্যবহারে অনীহা দেখিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত তারা ২০১৬ সালের অক্টোবরে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। কিন্তু হক–আই, স্নিকো মিটার ব্যবহার করলেও ডিআরএসেরই আরেকটি অংশ হটস্পট প্রযুক্তির প্রতি এখনো তারা অনীহা দেখিয়ে চলেছে।
কেন হটস্পট প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায় না বিসিসিআই? উত্তরটা দিয়েছেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক ও প্রধান কোচ অনিল কুম্বলে। টেলিভিশন নেটওয়ার্ক জিও সিনেমাকে কুম্বলে বলেছেন, ‘ভারতে হটস্পট ব্যবহার না করার একটা কারণ হতে পারে এটা সামরিক প্রযুক্তি। এ ছাড়া বিসিসিআই ও সম্প্রচার–সংশ্লিষ্টরা বলেছে, হটস্পট পরিচালনা করা ব্যয়বহুল।’
হটস্পট প্রযুক্তি বিকশিত করেন ফরাসি বিজ্ঞানী নিকোলাস বিয়ন। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য বিয়ন এই প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করেন। থার্মাল ইমেজিং সামরিক বাহিনীকে ট্যাংক ও জেট শনাক্ত করতে সাহায্য করে থাকে। অন্ধকার অবস্থায় এবং যুদ্ধক্ষেত্র যখন ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে, তখন প্রযুক্তিটি সামরিক বাহিনীকে কারও গতিবিধি শনাক্ত করে দেয়।
ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করে সেই প্রযুক্তিকেই পরে হটস্পট হিসেবে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ওয়ারেন ব্রেনান। তাঁকেই ক্রিকেটের হটস্পট প্রযুক্তির জনক মনে করা হয়। বিশ্ব–ক্রিকেটে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানোর অগ্রদূত হিসেবে পরিচিতি পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইন ২০০৬–০৭ অ্যাশেজে প্রথমবার এটি ব্যবহার করে। দেড় যুগ হতে চললেও ভারত এখনো হটস্পট প্রযুক্তি ব্যবহারে অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একজন সম্প্রচারকারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, হটস্পট প্রযুক্তি শতভাগ নির্ভুল নয়। যেহেতু স্নিকো মিটার বলে ব্যাটের ছোঁয়া ধরতে পারে, তাই হটস্পটের ব্যবহার খুব সীমিত। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে আরও যেসব যন্ত্রপাতি লাগে, সেগুলোও চার–পাঁচটির বেশি নেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আরও জানিয়েছে, হটস্পট ব্যবহারে দৈনিক ১০ হাজার ডলার (প্রায় ১২ লাখ টাকা) খরচ হয়ে থাকে। এ কারণে বেশির ভাগ সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান এটা ব্যবহার করে না। ইংল্যান্ডের স্কাই স্পোর্টস ও দক্ষিণ আফ্রিকার সুপারস্পোর্ট এরই মধ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আইসিসিও তাদের ইভেন্টে হটস্পটকে কখনো ডিআরএস প্রযুক্তির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেনি।