গত দুই দিনের উথাল-পাথাল সময় যেন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল সবাইকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তামিম ইকবালের হুট করে অবসর, প্রতিক্রিয়ায় আরও একবার বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের রাগত কণ্ঠ বেজে ওঠা, শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে তামিমের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং গণভবনের সামনে বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো সুখী পরিবারের ছবি।
মাত্র ২৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ভোজবাজির মতো এত কিছু ঘটে গেল যে, বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজটাই চলে গিয়েছিল প্রায় আড়ালে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আজ সেই আড়াল সরল এবং বাংলাদেশ দল দেখল এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার ছবি।
আফগান ব্যাটসম্যানদের সামনে অসহায় তাদের বোলিং-ফিল্ডিং, আফগান বোলারদের সামনে অসহায় তাদের ব্যাটিংও। ১৪২ রানের বড় হারে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ হারের যন্ত্রণা নিয়ে বাংলাদেশ ১১ জুলাইয়ের শেষ ম্যাচটা খেলবে কেবলই সান্ত্বনার জয় পাওয়ার আশায়। আফগানিস্তানের কাছে এর আগে এত বেশি রানের ব্যবধানে কখনো হারেনি বাংলাদেশ।
বৃষ্টি বিঘ্নিত প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা মাত্র ১৬৯ রানই করতে পেরেছিলেন। সেটা এতই কম হয়ে গিয়েছিল যে, ডিএলএস পদ্ধতির অঙ্ক মেলাতে বোলারদের আসলে তেমন কিছু করার ছিল না। কিন্তু আজ বোলাররাই প্রথম ম্যাচটা ফসকালেন, এরপর ব্যাটসম্যানরাও পারলেন না সেটিকে আর হাতে তুলে নিতে। ভারত বিশ্বকাপ সামনে রেখে ঘরের মাঠেও স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে খেলার পরীক্ষায় গত মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়া গেলেও আফগানরা বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিল মুদ্রার উল্টো পিঠও।
আফগানিস্তানের ৯ উইকেটে ৩৩১ রানের পাহাড় তাদের দুই ওপেনারেরই কীর্তি। সেটি কতটা তা বোঝাতে একটি তথ্যই যথেষ্ট। রহমানউল্লাহ গুরবাজ-ইব্রাহিম জাদরানের ২৫৬ রানের ওপেনিং জুটি ভাঙার পর আফগানিস্তান আরও ৮ উইকেট হারিয়ে যোগ করতে পেরেছে মাত্র ৭৫ রান। পরের দিকে আর একটু সমর্থন পেলে বাংলাদেশের লক্ষ্যটা ৩৭০-৩৮০ রানের হলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
গুরবাজ (১৪৫), ইব্রাহিম (১০০) দুজনই সেঞ্চুরি করে যে জুটিটা গড়েছেন, ওয়ানডেতে যে কোনো উইকেটেই সেটি এখন আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ। তাঁরা অতিক্রম করে গেছেন ২০১০ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে করিম সাদিক ও মোহাম্মদ শেহজাদের গড়া অবিচ্ছিন্ন ২১৮ রানের রেকর্ড জুটিটাকে।
গুরবাজ-ইব্রাহিমের দেয়াল হয়ে দাঁড়ানোতে চট্টগ্রামের উইকেটের ভূমিকা অবশ্যই ছিল। ব্যাটিংয়ের জন্য এত ভালো উইকেট তো কমই হয় বাংলাদেশে। প্রথম ওয়ানডের উইকেটও অনেকটা এ রকমই থাকলেও তাতে বাউন্স কিছুটা অসম ছিল। সে তুলনায় দ্বিতীয় ওয়ানডের উইকেট ছিল রীতিমতো ব্যাটিং স্বর্গ। কিন্তু এর মধ্যে আবার শুরুতেই বাংলাদেশের পেসারদের লাইন-লেংথও ছিল কিছুটা এলোমেলো। ব্যাটিং উইকেটে মেরে খেলায় ব্যাটসম্যানদের ন্যূনতম যে ঝুঁকিটা থাকে, আফগান ওপেনারদের জন্য সেরকম কিছুও তাই আর থাকল না।
টসে হেরে ব্যাটিং পেয়ে নির্বিঘ্নে এগোতে থাকল ইনিংস। প্রথম ৬ ওভারেই ৩৩ রান। অষ্টম ওভারে মোস্তাফিজুর রহমানের মাথার ওপর দিয়ে ইনিংসের প্রথম ছক্কা মারেন ১২৫ বলে ১৪৫ করা গুরবাজ, ওই ওভারেরই শেষ বলে তাঁর আরেকটি ছক্কা উড়ে যায় স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে।
মোস্তাফিজের ১৫ রান দেওয়া সেই ওভারেই শুরু গুরবাজ-ঝড়ের, যেটির হাইলাইটসেরও চুম্বক অংশ হয়ে থাকবে তাঁর ৮টি ছক্কা আর ১৩টি চার। সাকিব আল হাসানের করা ইনিংসের ১৩তম ওভারে পর পর দুই বলে চার আর ছক্কা মেরে ৪৮ বলেই ফিফটি হয়ে যায় গুরবাজের। সে তুলনায় একটু ধীরেই এগিয়েছেন ১১৯ বলে ১০০ করে আউট হওয়া ইব্রাহিম। ৯ বাউন্ডারির সঙ্গে তাঁর ছক্কা মাত্র ১টি।
৩৭তম ওভারে গুরবাজকে ফেরান সাকিব, পরের ওভারে রহমতে উইকেট নেন ইব্রাহিম। এরপর অবশ্য পাল্টা ঝড়ে আফগানিস্তানের ইনিংস দ্রুতই এগোতে থাকে লেজের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে যে রানটা উঠে গেছে, সেটাই অনন্ত চাপ হয়ে বসে বাংলাদেশের ওপর।
অবশ্য এটা যে চাপ, তা বোঝা গেছে পরে। নইলে বিশ্বকাপ সামনে রেখে তো কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পরিকল্পনাই হলো, ঘরের মাঠে ব্যাটিং উইকেট বানিয়ে বড় রানের ম্যাচ খেলা। আগে ব্যাটিং করলে নিজেদের বড় রান করতে হবে, পরে ব্যাটিং করলে প্রতিপক্ষের বড় রান তাড়া করার চ্যালেঞ্জ জিততে হবে। আজ সুযোগ এসেছিল দ্বিতীয়টি করে দেখানোর।
এটা ঠিক যে ৩৩১ রান তাড়া করে জেতার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বাংলাদেশের। ওয়ানডেতে এর আগে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান (৩২২) তাড়া করে জেতার রেকর্ড ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। চট্টগ্রামের মাঠেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২৮৭ তাড়া করে জিতেছে।
অবশ্য যে কোনো অভিজ্ঞতাই কখনো না কখনো প্রথম অর্জন করতে হয়। চট্টগ্রামের উইকেট আজ সেরকম কিছুর জন্যই ছিল আদর্শ। অথচ এমন উইকেটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কী করলেন! ৩৩১ তো দূর কি বাত, ৭২ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর মনে হচ্ছিল ১০০-এর নিচেই না অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ!
সে লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছে সপ্তম উইকেটে মুশফিকুর রহিম ও মেহেদী হাসান মিরাজের ৮৭ রানের জুটি। বোলিংয়ের সময় পায়ে চোট পাওয়া ইবাদত হোসেন ব্যাটিং না করায় মুশফিকের আউটের পরই খেলা শেষ। মুশফিকের ৮৫ বলে ৬৯ রানের ইনিংসটি অন্য ব্যাটসম্যানদের উইকেট দিয়ে আসার সর্বনাশা প্রতিযোগিতারই প্রতিবাদ হয়ে থাকল।
এর আগে বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয়ের শুরু ইনিংসের পঞ্চম ওভারে ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে লিটনের আকাশে ক্যাচ তুলে দিয়ে হওয়া আউটে। তামিম না খেলায় আফগান পেসার ফজলহক ফারুকিও বঞ্চিত হলেন তাঁকে টানা পঞ্চমবার আউট করার সুযোগ থেকে। তবে লিটনের উইকেট নিয়ে একটা জায়গায় ‘টানা ৫’ ঠিকই হলো ফারুকির। বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা ৫টি ওয়ানডেতেই যে তিনি নিলেন অধিনায়কের উইকেট!
এরপর কখনো মুজির উর রেহমান বা মোহাম্মদ নবীর অফ স্পিন, কখনো রশিদ খানের গুগলি একটার পর একটা উইকেট তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের। সঙ্গে দিয়ে গেছে এই সতর্কবার্তাও। শুধু ব্যাটিং উইকেটে খেলেই ম্যাচ জেতা যায় যায় না। ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং উইকেটের সুবিধা নিতেও জানতে হয়, বোলারদের চেনা থাকতে হয় এমন উইকেটেও লুকিয়ে থাকা ‘ডেথ স্পট’, যেখানে বল ফেলে ঘায়েল করা যায় প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের।