এর আগেও কখনো কখনো প্রশ্নটা উঠেছে। তবে এতটা উচ্চকিত হয়ে কখনোই নয়। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সাকিব আল হাসানকে নতুন এক অভিজ্ঞতাই হয়তো উপহার দিচ্ছে। সঙ্গে কি একটা বার্তাও?
পরিস্থিতির কারণে নেদারল্যান্ডস ও নেপাল ম্যাচও এখন যথেষ্টই বড়। তবে গ্রুপ পর্যায়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি ম্যাচ এরই মধ্যে শেষ। আচ্ছা, সেই দুই ম্যাচে কি সাকিব আল হাসান খেলেছেন? মনে করতে একটু কষ্টই হচ্ছে।
অলরাউন্ডারদের একটা সুবিধা থাকে। ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ হলে বোলিংয়ে পুষিয়ে দিতে পারেন। বোলিংয়ে ব্যর্থ হলে ব্যাটিংয়ে। সাকিবও ক্যারিয়ারে অনেকবারই তা করেছেন। বড় মঞ্চে টানা দুই ম্যাচে ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই এমন চরম ব্যর্থতার গল্প কি এর আগে লেখা হয়েছে কখনো? মনে করা যাচ্ছে না।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের শুরুতেই বাংলাদেশের রাশটা আলগা হয়ে যাচ্ছিল তাঁর কারণেই। দ্বিতীয় ওভারে ৪টি চার খেয়েছেন। এরপরও তিনি সাকিব বলেই হয়তো তাঁকে আরেকটা ওভার দিয়েছেন অধিনায়ক। চতুর্থ ওভারটা দেওয়ার আর সাহস পাননি বা প্রয়োজন বোধ করেননি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অবস্থা তো আরও করুণ। বোলিং করেছেন মাত্র ১ ওভার। পুরো ২০ ওভার খেলা হয়েছে, এমন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এর আগে কখনোই সাকিবের যে অভিজ্ঞতা হয়নি। যে ১২৪টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, তার দুটিতে বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ বোলিংই করেনি। বাকি ১২২ ইনিংস ধরে ধরে খুঁজলে আর একটা ম্যাচই পাবেন, যেখানে সাকিব মাত্র ১ ওভার বোলিং করেছেন। ২০২৩ সালের মার্চে চট্টগ্রামে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র এক ওভার করার কারণ ছিল বৃষ্টির কারণে সেটি ৮ ওভারের ম্যাচ হয়ে যাওয়া। এটিকে তাই হিসাবের বাইরেই রাখতে পারেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহকে দিয়ে ৩ ওভার বোলিং করিয়েছেন অধিনায়ক। প্রথম ৩ ওভারে ভালো না করার পরও ১৯তম ওভারে রিশাদ হোসেনকে ফিরিয়ে এনেছেন আবার। সাকিবের ৩ ওভার বাকি থাকলেও তাঁকে ডাকার কথা ভাবেননি। নাজমুল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে এলে কারণটা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যেত। তবে অনুমান তো করাই যায়, সাকিবের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
তা বোলিংয়ে কিছু করতে না পারুন, ব্যাটিংয়ে তো তা পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শুরুতেই ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর লিটন দাস আর তাওহিদ হৃদয় দারুণ একটা মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিলেন সাকিবের জন্য। যখন নেমেছেন, ৫০ বলে বাংলাদেশের দরকার মাত্র ৩৪ রান। রান রেটের কোনো চাপ নেই। চাপ বলতে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলো উপলক্ষের চাপ, বিশ্বকাপে ভালো একটা শুরু করার চাপ। সেই চাপ সামলানোর মতো অভিজ্ঞতা এই দলে আর কার আছে?
যেভাবে আউট হয়ে দলকে বিপদে ফেলে এলেন, তাতে সেই অভিজ্ঞতার মূল্য রইল কই! ম্যাচটা তো হেরেও যেতে পারত বাংলাদেশ। তাহলে নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি করে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো সাকিবকে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওই ব্যাটিং–দুরূহ উইকেটেও সাকিবের অভিজ্ঞতার কাছে বড় চাওয়া ছিল। প্রতিপক্ষ দলের সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলারকে পুল করতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মনে হয় না সেটির প্রতিফলন ঘটেছে।
দুই ম্যাচ মিলিয়ে মোট ৪ ওভার বোলিং, কোনো উইকেট নেই। ব্যাট হাতে রান মোট ১১। এটা সাকিব আল হাসানই তো, নাকি সাকিবের ছায়া! নাকি এত কাব্য না করে শিরোনামের প্রশ্নটাই আবার তুলে দেওয়া উচিত! এই বিশ্বকাপেই কি সাকিবের শেষের শুরু দেখে ফেলছি আমরা?
প্রশ্নটা বিপজ্জনক। চ্যাম্পিয়নদের ব্যাপারে শেষ কথা বলে ফেলতে নেই। পরে লজ্জায় পড়ার ঝুঁকি থাকে। শচীন টেন্ডুলকারের খারাপ সময়ে তাঁর শেষ ধরে নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকা Endulkar হেডিং করেছিল। সেটি ২০০৬ সালে ভারতের পাকিস্তান সফরের সময়। এরপর টেন্ডুলকার আরও সাত বছর খেলেছেন। সেটিও ব্যাটে ফল্গুধারার মতো রান ছুটিয়ে।
সাকিবের শেষ দেখে ফেলার কথা হয়তো এর আগে বলা হয়নি কখনো। তবে খারাপ সময় অল্পবিস্তর তাঁরও এসেছে। এ নিয়ে কথাবার্তা অবশ্য দ্রুতই থামিয়ে দিয়েছেন দারুণ কোনো পারফরম্যান্সে। তাৎক্ষণিকভাবে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথা মনে পড়ছে। সাকিবের অবস্থা এমনই খারাপ যে নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে তাঁকে বাদ দেওয়ার অভাবনীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে। চূড়ান্ত, কারণ সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে ঢাকায়। অধিনায়ক মাশরাফি ও কোচ হাথুরুসিংহে একজোট হয়ে যা হতে দেননি। পরদিন নিউজিল্যান্ড ম্যাচে সাকিব কী করেছিলেন, তা আপনার মনে থাকার কথা।
আবার কি অমন ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন সাকিব? সুযোগ তো আছেই। নেদারল্যান্ডস আর নেপালকে পাচ্ছেন সামনে, সেটিও সেন্ট ভিনসেন্টের উইকেটে। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট লিগে খেলার অভিজ্ঞতা থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বেশির ভাগ মাঠই সাকিবের খুব ভালো চেনা। এই দুই ম্যাচের ভেন্যু সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নস ভেল তো সাকিবের কাছে এক সুখস্মৃতির নামও। ২০০৯ সালে এই মাঠেই সিরিজের প্রথম টেস্টে মাশরাফি চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর অধিনায়ক সাকিবের যাত্রা শুরু।
এসব অবশ্য অনেক পুরোনো কথা। ভাবাবেগেরও বলতে পারেন। সাকিব আর আগের সেই তরুণ নেই। ক্রিকেটের বাইরে আরও হাজারো কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর জীবনটাও আর আগের মতো সরল নয়। সবকিছু সামলে অতীতে আরও অনেকবারের মতো এবারও কি ফিরতে পারবেন স্বরূপে? নাকি একসময় এই বিশ্বকাপের দিকে ফিরে তাকিয়ে সবার মনে হবে, এখানেই সাকিবের শেষের শুরু।