বিপিএলে এবার সিনে–তারকাও থাকছেন। শাকিব খান, দেশের এক নম্বর ফিল্ম স্টার। তবে তিনি থাকছেন কেবলই একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকপক্ষে, নইলে ৩০ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া বিপিএলের ১১তম আসরের সার্বিক পরিকল্পনায় থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ মস্তিষ্কের ছাপও। টুর্নামেন্টের জৌলুশ নিশ্চয়ই বাড়বে এসবে।
ফারুক আহমেদের নতুন বিসিবির নতুন বিপিএল অনেক নতুনত্বের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বোর্ড সভাপতি ফারুক এই আশ্বাসও দিয়েছেন, বিপিএল বিতর্কের জঞ্জালমুক্ত হবে। পরশু মুঠোফোনে আরও একবার আশার কথা শুনিয়ে বলেছেন, ‘বিপিএল নিয়ে আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি। এবার প্রধান উপদেষ্টা তাঁর অলিম্পিক অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বিপিএলে অনেক ব্যতিক্রম ও নতুনত্ব দেখতে পাবেন সবাই।’
টুর্নামেন্টের আর্থিক বৈষম্য দূর করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি আছে বোর্ড সভাপতির। খেলোয়াড়দের বকেয়া শোধ থেকে শুরু করে এবার আম্পায়ার–স্কোরারদের টাকাও নাকি বাড়বে। ভালো মানের ধারাভাষ্যকার আনা হবে, এমনকি লিগের মাঝপথে টুর্নামেন্টের বাইলজ বদলাবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ফারুক।
মুঠোফোনে শেষের প্রতিশ্রুতিটা দিতে গিয়ে বোর্ড সভাপতি হেসে ফেললেন, যেটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণও বটে। বিপিএলের আগের ১০টি আসরের গায়ে লেপ্টে থাকা অজস্র বিতর্কের মধ্যে টুর্নামেন্টের মাঝপথে বাইলজ বদলে ফেলার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও যে আছে! প্রতিশ্রুতির তালিকায় সেটি না রেখে তাই পারছেন না ফারুক।
বিপিএলের জন্ম ২০১২ সালে এবং জন্ম থেকেই বিতর্কের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। কখনো স্থানীয় খেলোয়াড়দের টাকা বাকি থেকে যায়, কখনো বিদেশি খেলোয়াড়েরা বকেয়া পাননি বলে অভিযোগ করে বসেন। লিগের মাঝপথে বাইলজ বদলের কথা তো বলাই হলো, সঙ্গে কখনো বিশেষ কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া, কখনো খেলোয়াড়–মালিক মিলে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি। রাজস্বের ভাগ পাওয়ার দাবিতে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল বনাম ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের দ্বন্দ্ব তো বলতে গেলে প্রতি বিপিএলেরই নিয়মিত চিত্র। ঝামেলা কম হয়নি ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি আর ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়েও।
ফারুক আহমেদের বোর্ড যতই নতুন বিপিএলের স্বপ্ন দেখাক, বিপিএলে বিতর্কের ধারাবাহিকতায় ছেদ টানতে পারবেন কি না, সেটা তাই একটা প্রশ্ন। এবার তো বরং টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই অন্তত তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নিয়ে বিসিবিতেই সংশয়–সন্দেহের বাতাবরণ ছড়াতে শুরু করেছে! এই ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মালিকপক্ষ নিয়ে যেমন কৌতূহল আছে, তেমনি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক প্রদানসহ তাদের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন কেমন হয়; সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হচ্ছে বিসিবিকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার ভাষায়, ‘কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির ওপর আমাদের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। ওদের ব্যাপারে এখন থেকেই আমাদের চোখ–কান খোলা আছে।’
বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর চলতি চক্রের শেষ আসর এবার। আগামী বছর নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়া হবে পরের চক্রের জন্য। নতুন চক্রে বর্তমান ফ্র্যাঞ্চাইজিদের রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের এবারের আচরণকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ওদিকে বিপিএলের সম্প্রচারস্বত্ব নিয়েও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্বত্বাধিকারীদের ই–মেইলে পাঠানো এক ‘আবেদনপত্র’। গতবারের দশম ও এবারের একাদশ বিপিএলের জন্য ৫৬ কোটি টাকায় সম্প্রচারস্বত্ব কিনেছে মিলেনিয়াম মিডিয়া লিমিটেড, গাজী স্যাটেলাইট টিভি লিমিটেড, বেনটেক ও এশিয়াটিক এমইসি নামের চারটি প্রতিষ্ঠানের মিলিত কনসোর্টিয়াম। কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্বে আছে মিলেনিয়াম মিডিয়া, খেলার চ্যানেল টি–স্পোর্টস, যাদের মালিকানায়।
সূত্র জানিয়েছে, গত বিপিএলের পাওনা ২৮ কোটি টাকা থেকে এই কনসোর্টিয়াম এখনও বিসিবিকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা দেয়নি। এর মধ্যেই সম্প্রতি তারা বিসিবিকে চিঠি দিয়ে এবারের বিপিএলের ২৮ কোটি টাকা থেকেও বেশ ভালো অঙ্কের ছাড় চেয়েছে।
সম্প্রচারস্বত্বাধিকারীদের ছাড় চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘তারা একটি চিঠি দিয়েছে, যেখানে এবারের বিপিএল থেকে তারা কিছু টাকা ছাড় চেয়েছে বলে জানি। চিঠিটি আমি এখনো দেখিনি।’ কত টাকা ছাড় চাওয়া হয়েছে, সভাপতি সেটি নিশ্চিত করতে না পারলেও জানা গেছে, ২৮ কোটি থেকে আনুমানিক ১২ কোটি টাকার মতো ছাড় চাওয়া হয়েছে।
বিসিবি সভাপতি যদিও বলেছেন, ‘ছাড় চাইলেই ছাড় পাওয়া যাবে, বিষয়টি সে রকম নয়। বোর্ড সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে’, সঙ্গে এ–ও বলেছেন, ‘বিসিবির পার্টনার হিসেবে তারা যদি কোনো সমস্যায় থাকে, সেটিও আমাদের দেখতে হবে।’
সম্প্রচারস্বত্বাধিকারীদের গত বিপিএলের বকেয়া নিয়ে ফারুক জানিয়েছেন, সেই টাকা ভাগে ভাগে দিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সম্প্রচারস্বত্বাধিকারীরা, ‘আমরা চেষ্টা করছি সব টাকা উদ্ধার করতে। এ জন্য একটা সময়সীমাও দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সব টাকা দিয়ে দেবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা না দিলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’
বিপিএলের বিতর্কের তালিকার মতোই দীর্ঘ এর বাকির খাতাও। প্রায় এক যুগ পর টুর্নামেন্টে ফেরা চিটাগং কিংসের কাছেই যেমন কাটছাঁট করে সাড়ে ৩ কোটি থেকে ৪ কোটি টাকার মতো পায় বিসিবি। চিটাগং কিংসও অবশ্য এই টাকা দিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিসিবিকে। বিভিন্ন খাতে বিপিএলের পাওনা আছে আগের কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছেও। এগুলো নিয়ে শুনানি বাকি আছে। সব মিলিয়ে এখানে টাকার অঙ্কটা ১৫ থেকে ২০ কোটির মতো।
ফারুক আহমেদ বিপিএলে যে নতুনত্বের স্বপ্ন দেখছেন, সেটিকে সত্যিকার অর্থেই রঙিন করতে হলে দূর করতে হবে বিতর্কের জঞ্জালও। বাকির খাতাটিকেও আর দীর্ঘ না করে বন্ধ করাই উত্তম। কিন্তু তা কি সম্ভব?