এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের লড়াইটা কিন্তু সেই রকম এক দলের সঙ্গে হচ্ছে। ওয়ানডের ব্যাকরণ নতুন করে লেখা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল। কিসের লড়াই, তা অবশ্য আগেই পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। অনেক আশা নিয়ে বিশ্বকাপে এসে চরম হতাশার প্রতিশব্দ হয়ে যাওয়ার লড়াই। যে লড়াইয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের সঙ্গে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ।
পারবে কীভাবে, বিশ্বকাপে এসে হঠাৎই খেলা ভুলে যাওয়ার দিক থেকে এবারের ইংল্যান্ড দল তো সর্বকালীন চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বকাপ এমন কিছু এর আগে দেখেইনি। চাইলে আপনি তাই এ থেকে সান্ত্বনা খুঁজতে পারেন। ইংল্যান্ডেরই যদি এমন অবস্থা হয়, বাংলাদেশের তো হতেই পারে।
একটা সন্দেহ যদিও হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের কাছে পরাজয়ের ক্ষতটা এখনো এমন দগদগে যে তাতে প্রলেপ দেওয়ার জন্য এটাও হয়তো যথেষ্ট নয়। ইংল্যান্ড দু–তিন ম্যাচ হারার পর থেকেই ইংলিশ সাংবাদিকেরা ইংল্যান্ডের এই পতনের কারণ নিয়ে লিখতে শুরু করেছেন। বিশ্লেষণ ও কল্পনাশক্তিভেদে সেই কারণের সংখ্যা ৫ থেকে ১০ পর্যন্ত হচ্ছে। এখন ইংল্যান্ডের একেকটা ম্যাচ যায়, আর তাঁরা সেটি আপডেট করেন।
ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশ বিশ্বকাপের বড় কোনো নাম নয়। সেমিফাইনালেই তো খেলা হয়নি কখনো। ‘ইংল্যান্ডের পতন’ কথাটা তাই ঠিক আছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। আমরা বরং একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারি। গত দেড়–দুই বছর ওয়ানডেতে যেমন খেলেছে বাংলাদেশ, বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স তার ধারেকাছেও নেই কেন!
ইংল্যান্ডের মতো এত এত কারণ খোঁজার দরকার নেই। বাংলাদেশের দুর্দশার ব্যাখ্যায় একটা কারণই মনে হয় যথেষ্ট। স্কোরবোর্ডে যথেষ্ট রান তুলতে না পারা। ডাকওয়ার্থ-লুইসের ব্যতিক্রম বাদ দিলে ওভার-নির্দিষ্ট খেলায় জয়ের পূর্বশর্ত তো ওই একটাই—প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি রান করা। দলের প্রায় সব ব্যাটসম্যান একসঙ্গে ফর্ম হারিয়ে ফেললে সেটি আর কীভাবে হবে!
বিশ্বকাপের ৬ ম্যাচে একটি মাত্র সেঞ্চুরি। হাফ সেঞ্চুরিও ম্যাচপ্রতি একটি করে। এর মধ্যে একাধিক, মানে ২টি করে হাফ সেঞ্চুরি লিটন ও মুশফিকের। কিন্তু বাকি চার ইনিংসে লিটনের মোট রান ৪৮, মুশফিকের ৪৯। অন্যদের অবস্থা এমন খারাপ যে এই দুজনকেও মানতে হচ্ছে মন্দের ভালো বলে। ওপেনিংয়ে লিটনের সঙ্গী তানজিদ হাসান। নতুন বলে তাঁর কাছে খুব বেশি আশা হয়তো কারোই ছিল না। যে দুজনের কাছে ছিল, তাঁদের ব্যাটিং ভুলে যাওয়াই আসলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ এমন দুঃস্বপ্ন হয়ে যাওয়ার মূলে। একজন সাকিব আল হাসান। ৫ ইনিংসে যাঁর মোট রান ৬১, এর ৪০-ই আবার এক ইনিংসে। এর চেয়েও বড় হতাশার নাম নাজমুল হাসান।
গত এক–দেড় বছর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ধারাবাহিক। এই বিশ্বকাপে আসার আগে যাঁর সর্বশেষ তিনটি ওয়ানডে ইনিংস ৭৬, ১০৪ ও ৮৯ রানের। আর বিশ্বকাপে এসে? আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৫৯ রানের পর টানা পাঁচ ইনিংসে দুই অঙ্কে যেতে ব্যর্থ—দুবার তো শূন্য রানেই আউট। ঠিক যেন এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের প্রতিচ্ছবি। ঝলমলে শুরুর পর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া।
ক্যারিয়ারে এই প্রথম এমন টানা ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না সাকিব। নাজমুলও বুঝতে পারছেন না, কেন বাজে বলে এমন উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসছেন। বোর্ড সভাপতিকে দুঃখ করে বলেছেন, ‘ভালো বলে আউট হলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু আমি তো ফালতু সব বলে আউট হচ্ছি।’
ব্যাটিং ভালো হচ্ছে না, রান হচ্ছে না—এটা তো সবাই দেখছেই। কারণটা খুঁজে বের করার দায়িত্বটা কি কেউ নিয়েছেন? নাকি তা করতে গেলে নিজেদের দোষই সামনে চলে আসে! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ছন্নছাড়া ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছে, এতে একটা সেঞ্চুরির ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। গত এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের সঙ্গে ওপেন করতে নেমে মেহেদী হাসান মিরাজের সেঞ্চুরিটাই তো সব ঝামেলার মূলে। এরপর থেকেই তাঁকে নিয়ে কোচ-অধিনায়কের আদেখলাপনার শুরু।
বিশ্বকাপে সেই আফগানিস্তানের বিপক্ষেই হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলায় যা আরও বেড়েছে। কখনো তিনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে, কখনো বা চার-পাঁচে। তাঁর চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যানরা নিচে চলে যাচ্ছেন। এর চেয়েও বড় সমস্যা, এত দিনের অভ্যস্ত পজিশন বদলে যাওয়া। তিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা নাজমুলকে একাধিক ম্যাচে সরানো হয়েছে, পাঁচে ব্যাটিং করে এত রান করা তৌহিদ হৃদয়কেও। নাজমুল নামের জোরে এখনো টিকে আছেন, হৃদয় তো বাদই পড়ে গেছেন দল থেকে। প্রশ্ন উঠছে মাহমুদউল্লাহর এত পরে নামা নিয়ে। আগের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করার পরও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কেন সাতে নামাতে হবে তাঁকে?
অধিনায়ক ও কোচের সঙ্গে বোর্ড সভাপতির আলোচনায় ব্যাটিং অর্ডারও ছিল। বাকি তিন ম্যাচে সেটির প্রতিফলন দেখা যাবে বলেই জানিয়েছে একটি সূত্র।
তা যদি হয়ও, একটু দেরিই হয়ে গেল মনে হয়।