অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! অভূতপূর্ব!
আর কী বলা যায়, বলুন তো!
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ধবলধোলাই করার বর্ণনায় উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেতে কী কসরতটাই না করতে হচ্ছে!
লেখার শুরুতে যে তিনটি শব্দ, তিনটিই অবশ্য যথার্থ। যা বিশ্বাস হতে চায় না, তা তো অবিশ্বাস্যই। অভাবনীয় মানে, যা ভাবা যায়নি। আর অভূতপূর্ব...আপনার কুঁচকে যাওয়া ভুরু কল্পচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। অনুমান করতে পারছি বিরক্তিটাও। আরে, আনন্দের এক গল্প বলতে গিয়ে এ দেখি শব্দার্থের স্কুল খুলে বসেছে! এসব বুঝি আমরা জানি না!
অবশ্যই জানেন। যা জানেন না, তা হলো এসব লেখার কারণ। সেটি কী? টি–টোয়েন্টি সিরিজে ওই ধাঁধার মতো ৩–০ স্কোরলাইনটা সামনে রেখে লিখতে বসে সব তালগোল পাকিয়ে যাওয়া।
এত কিছু বলেও যেমন মনে হচ্ছে, সবটা কি বোঝানো গেল! নাকি ‘অকল্পনীয়’ শব্দটাই এখানে সবচেয়ে ভালো মানাত। অকল্পনীয়, মানে যা কখনো কল্পনা করা যায়নি—এটির এককথায় প্রকাশ হিসেবে তো এখন অনায়াসেই ‘ইংল্যান্ডকে–ধবলধোলাই’ কথাটাকে চালিয়ে দেওয়া যায়। অতিশয়োক্তি মনে হচ্ছে? অতি আবেগ? তাহলে আপনাকে ৯ মার্চ টি–টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচের দিন সকালে ফিরে যেতে বলি। একটু মনে করে দেখুন তো, চার দিন পর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এই আলোর রোশনাই ছড়ানো, কনফেত্তি ওড়ানো রাতের কথা আপনি কল্পনাও করতে পেরেছিলেন কি না! উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে ক্ষমা করে দিতে বলি। আপনি ভাই নস্ত্রাদামুসের বংশধর। দিব্যচোখে ভবিষ্যৎ দেখতে পান।
আসল উত্তরটা কী, এটা আসলে আমরা সবাই জানি। আমিও ভাবিনি, আপনিও ভাবেননি, কেউই ভাবেনি। ওয়ানডে সিরিজে যদি এই ঘটনা ঘটত, মানে ইংল্যান্ডকে ধবলধোলাই করে ফেলত বাংলাদেশ—তা এমন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়ার মতো কিছু হতো না। অথচ ইংল্যান্ড কিন্তু ২০ ওভারের মতো ৫০ ওভারের বিশ্বকাপেরও চ্যাম্পিয়ন। তাহলে পার্থক্যটা কী?
পার্থক্য ওই ৩০ ওভারের। মানে ওয়ানডে আর টি–টোয়েন্টির। ইংল্যান্ড ওয়ানডের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, তবে এই সংস্করণে বাংলাদেশও একদমই হেলাফেলার দল নয়। দেশের মাটিতে বরং পরাক্রান্ত শক্তিই। যেখানে টি–টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ড যদি ক্লাসের ফার্স্ট বয় হয়, বাংলাদেশ একেবারে পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। টেস্টেও বাংলাদেশ এখনো অকূলপাথারের যাত্রী, তবে টি–টোয়েন্টি মানে তো রীতিমতো সাগরে হাবুডুবু। নতুন করে আবার দায়িত্ব নেওয়ার পর কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কি আর অকারণে তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সবচেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের কথা বলেছিলেন। এখন স্বীকার করবেন কি না জানি না, তবে টি–টোয়েন্টি সিরিজের একটা ম্যাচ জিতলেই সম্ভবত খুশি থাকতেন হাথুরুসিংহে। সাকিবও হয়তো তাই।
সেখানে সিরিজের তিন ম্যাচেই জয়! সেই জয়ও যেনতেনভাবে কেঁদে–কঁকিয়ে পাওয়া নয়। যা এসেছে প্রবল শৌর্যের পিঠে সওয়ার হয়ে। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন বিভাগেই শ্রেয়তর দল হিসেবে। টি–টোয়েন্টিতে টানা এমন তিনটি ম্যাচ বাংলাদেশ আর কখনোই খেলেনি। ছোট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্য—এ নিয়ে তো কোনো প্রশ্নই নেই। শুধু টি–টোয়েন্টিতেই না থেকে সীমানাটা যদি আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়? তাতেও এ দেশের ক্রিকেটের অবিস্মরণীয় অর্জনগুলোর একেবারে ওপরের দিকেই থাকবে এটি। তুলনায় কী আসতে পারে? ২০১৫ সালে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা সিরিজ জয়ের কথা মনে পড়বে। এই তিন সিরিজের মধ্যে পাকিস্তানও হেরেছিল ৩–০তে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়ের কথা আসবে, মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয় তো অবশ্যই। তবে এই টি–টোয়েন্টি সিরিজের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মেলানো যায় সম্ভবত ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪–০ জয়ের সেই ওয়ানডে সিরিজকে। তখন বাংলাদেশ দলের যে অবস্থা ছিল, তাতে ৪–০ও এই লেখার শুরুতে ব্যবহার করা শব্দগুলোর অনুভূতিতেই আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল সবাইকে।
‘বাংলাওয়াশ’ শব্দটার ক্রিকেট অভিধানে ঢুকে যাওয়াও সেই সিরিজেই। এর আগের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই প্রথম যা ব্যবহার করেছিলেন ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান। তবে তখন তা অতটা প্রচার পায়নি। নিউজিল্যান্ড ধবলধোলাই হওয়ার পর এতটাই পেল যে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে দেখেছি, ওই দেশের ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট সবারই তা জানা হয়ে গেছে। এরপর বাংলাদেশের ক্রিকেটে ক্রমশ হোয়াইটওয়াশের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে বাংলাওয়াশ। যেটিকে প্রতিপক্ষের জন্য অপমানকর বলে আপত্তিও শুনেছি। তবে হোয়াইটওয়াশেও তো বর্ণবাদের গন্ধ খুঁজে পান অনেকে। যে কারণে আশির দশকে ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা রংটা বদলে দিয়ে এর নাম দিয়েছিল ‘ব্ল্যাকওয়াশ’।
এখানে কী বলা যায়—ইংরেজদের বাংলাওয়াশ? ভালোই তো শোনায় দেখি। ইংল্যান্ডের কেউ যদি আপত্তি তোলেন, তাহলে তাঁকে পুরোনো একটা গল্প শুনিয়ে দেওয়া যায়। গল্প বলছি, তবে তা নির্জলা সত্যি। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম সফরে লর্ডস টেস্টে তিন দিনের মধ্যে হেরে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘ভবিষ্যতে এই বিতিকিচ্ছিরি বাংলাদেশ দল যেন লর্ডসের ১০০ মাইলের মধ্যে আসতে না পারে।’
আমরা অবশ্যই তা বলব না। অতিথিপরায়ণ হিসেবে আমাদের সুনাম আছে। আমরা বরং বলব, ইংল্যান্ড বারবার ফিরে আসুক এই দেশে। ভাসিয়ে দিয়ে যাক এমন আনন্দধারায়।