বাংলাদেশের এশিয়া কাপ শুরু হচ্ছে আজ থেকে। এই এশিয়া কাপেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ম্যাচসেরা হয়েছিলেন আতহার আলী খান। সাকিব আল হাসানদের আজ মাঠে নামার দিনে ১৯৯০ এশিয়া কাপের সেই স্মৃতি মনে করেছেন সাবেক এই ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার।
আমার ভাগ্য ভালো, এখনো আমি নানাভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত। খেলোয়াড়, নির্বাচক ও ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছি অনেক দিন হয়ে গেল। পেশার সুবাদে ম্যাচ শেষে অনেক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করা হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জেতাটা খুব বড় কিছু মনে করে না, এটা ওদের কাছে এখন আর নতুন কিছু নয়। ওরা এখন ম্যান অব দ্য সিরিজ, ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হতে চায়। ওরা এখন বিশ্বকাপ জিততে চায়। ভাবতে ভালো লাগে, এই বিবর্তনে আমি ছোট হলেও অবদান রাখতে পেরেছি।
ভাগ্যক্রমে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটা আমি পেয়েছি, যা আজও আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। ১৯৯০ এশিয়া কাপের কথা, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯৫ বলে ৭৮ রান করে অপরাজিত ছিলাম আমি। বাংলাদেশ ম্যাচ হারলেও আমি সেদিন ম্যাচসেরা হয়েছিলাম। আমার মনে আছে, সেই ম্যাচের আগের ম্যাচটা আমরা খেলেছিলাম ভারতের বিপক্ষে চণ্ডীগড়ে।
ভারতের বিপক্ষে আমার আর ফারুকের একটা ১০০ ছাড়ানো (১০৮ রান) জুটি ছিল। সম্ভবত সেটাই বাংলাদেশের প্রথম ১০০ রানের জুটি। ফারুক ফিফটি করেছিল, আমি মনে হয় ৪৪ রান করেছিলাম। ভারতের বিপক্ষে ওদের ঘরের মাঠে ওই জুটিটা গড়তে পারা আমাদের জন্য তখন বিরাট ব্যাপার ছিল। আর কন্ডিশনও ব্যাটিংয়ের জন্য সহজ ছিল না। যেহেতু ওই কন্ডিশনে ভালো ব্যাটিং করেছিলাম, আমি ইডেনে গিয়েছিলাম অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কেন জানি মনে হচ্ছিল, আমি এখানে ভালো করব।
প্রথমবার ইডেন গার্ডেনে খেলতে নামার স্মৃতিটা আমার মনে এখনো জ্বলজ্বলে। এত সুন্দর মাঠ! মনে হচ্ছিল, এখানে রান না করলে কোথায় করব! অদ্ভুত একটা অনুভূতি।
মনে আছে, আমি বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করছিলাম। বল বাউন্ডারি থেকে থ্রো করছিলাম, আর খুব দ্রুত তা কিপারের কাছে যাচ্ছিল। মাঠটা ছিল এককথায় সুপার। এত ফাস্ট আউটফিল্ড, ওরে বাপ রে বাপ!
যখন আমি ব্যাটিংয়ে নামি, তখন প্রথম বলটাই একদম ব্যাটের মাঝখানে লাগে। এখনো মনে আছে, সেই ফরোয়ার্ড ডিফেন্সটা। তখন আমি চারে খেলতাম। সেদিন ২০-২২ রানে (২৩ রানে) মনে হয় ২ উইকেট পড়ে যায়। ওই অবস্থায় প্রথম বলটা ভালোমতো খেলতে চাইছিলাম। হয়েছেও তা–ই। একদম সলিড ডিফেন্স। আমি ভাবলাম, ওহ, সুইট সাউন্ড!
তখনই মনে হচ্ছিল, আজ কিছু একটা হবে। আমরা রান তাড়া করছিলাম। উইকেট পড়ে যাওয়াতে আমি মেরে না খেলে একটু ধরে খেলছিলাম। অ্যাগ্রেসিভ হয়েছিলাম, যখন স্পিনার এসেছিল। ডন আনুরাসিরিকে একটা ছক্কা মেরেছিলাম। মনে আছে, আমি শুধু সোজা পুশ করেছিলাম, ওটা ছক্কা হয়ে যায়। আমি খুব অবাক হই ছক্কা হতে দেখে। নিজেই ভাবছিলাম, কী ব্যাপার, আমি তো শুধু হালকা পুশ করলাম, ছয় হয়ে গেল! দুই বল পর আবার আরেকটা ছক্কা, সেটা একটু জোরে মেরেছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল, নাহ, এবার একটু চান্স নেওয়া যায়। পরের ওভারে অরবিন্দ ডি সিলভার প্রথম বলেই আবার ছক্কা! ছয়-সাত বলের মধ্যে তিনটা ছক্কা মেরেছিলাম।
অর্জুনা রানাতুঙ্গা ছিল শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক। ওই ছক্কাগুলোর পর সে একটু নেগেটিভ অ্যাপ্রোচে চলে যায়। লেগ সাইডের দিকে বল করাচ্ছিল বেশি বেশি। আমিও মজা করে লেগ স্টাম্প তুলে একবার ওদের দেখিয়েছি। বলেছি, ভাই, কোথায় বল করছ? নান্নুর (মিনহাজুল আবেদীন) সঙ্গে আমার ৫০ রানের একটা জুটি হয়েছিল। আমরা ম্যাচটাকে আরেকটু গভীরে নিয়ে যেতে চাইছিলাম। সেটা হলে হয়তো জয়ের কাছেও যেতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। আসলে আমরা তখন এত সাহসী ছিলাম না যে চাইলেই ছক্কা মেরে দেব।
ম্যাচ শেষের অভিজ্ঞতাটাও অন্য রকম। আমি ৭৮ রানে নটআউট ছিলাম, কিন্তু আমরা ম্যাচটা হেরেছিলাম। প্রেজেন্টেশনে যখন আমার নামটা ডাকা হয়, প্রথমবার কিন্তু আমি তা বুঝিনি। কেউ একজন এসে আমাকে বলেছিল, ‘এই আতহার, তোমার নাম ডাকছে। তুমি তো ম্যান অব দ্য ম্যাচ।’ আমি তো অবাক! কারণ, অরবিন্দ ডি সিলভা আমার চেয়ে বেশি রান করেছে, আমার চেয়ে দ্রুতও। তার দল জিতেছে। তারই ম্যাচসেরা হওয়ার কথা। আমি খেলা শেষে সাংবাদিকদেরও বলেছিলাম, ম্যান অব দ্য ম্যাচ অরবিন্দরই হওয়ার কথা।
ইডেন গার্ডেনের মতো মাঠে ম্যান অব দ্য ম্যাচ পাওয়া দারুণ অভিজ্ঞতা। একটা কষ্ট আছে, সেই ম্যান অব দ্য ম্যাচের কোনো ট্রফি আমার কাছে নেই। আমাকে পরে ট্রফি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর পাইনি কোনো কারণে। তবে আমার ইনিংসটা অনেক সেলিব্রেট করা হয়েছে। অনেক কাভারেজ পেয়েছে। পত্রিকায় অনেক লেখা হয়েছে। আমার কাছে কিছু পেপার কাটিংও আছে। স্ক্র্যাপবুক ছিল। আমার মা এসব সংগ্রহ করতে পছন্দ করতেন।
ওই ইনিংসটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটার পরেই আমরা মনে করতে শুরু করি, নাহ, আমরাও পারি। এর আগে আমরা শুধু টিকে থাকার চিন্তা করতাম। কীভাবে ৫০ ওভার খেলব, সেটাই থাকত লক্ষ্য। আমি মনে করি, ওই ইনিংসটা সেই উপলব্ধি দিয়েছিল, নাহ, আমরাও হয়তো জয়ের সম্ভাবনা জাগাতে পারি। ম্যাচের পরেও কথা হচ্ছিল, আমার ইনিংসের সঙ্গে যদি আরও দু-একজন ভালো করত, তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু হতেও পারত।
একটা কথা বলে রাখি, তখন কিন্তু আমরা খুব বেশি অনুশীলনের সুযোগ পেতাম না। সাপোর্ট স্টাফ কম ছিল। দলে কোনো ফিজিও ছিল বলে মনে পড়ে না। প্রধান কোচ, সহকারী কোচ…এই তো। আমরা বছরে ম্যাচ খেলতাম একটি-দুটি। আমি নিজেই তো প্রায় ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছি, কিন্তু ম্যাচ খেলেছি মাত্র ১৯টা।
তখন চিন্তাভাবনাটা ছিল এমন—খেলব, অভিজ্ঞতা নেব। ওই এশিয়া কাপের পর আমাদের উপলব্ধি হয়, আরেকটু পরিশ্রম করলে হয়তো আরেকটু ভালো করা সম্ভব। তখনকার ওই ছোট ছোট ব্যক্তিগত অর্জনই পরে আমাদের দলীয় সাফল্যের কথা চিন্তা করার সাহস দিয়েছে।