২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর আইসিসি হল অব ফেম ঘোষণা করার পর থেকে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের ঘনিষ্ঠজনেরা খোলাচিঠি লিখছেন। ১১০ নম্বর জায়গা পাওয়া অরবিন্দ ডি সিলভাকে লিখেছেন মাহেলা জয়াবর্ধনে।
পাবেন, অরবিন্দ আইয়া (বড় ভাই),
আইসিসির হল অব ফেমে চতুর্থ শ্রীলঙ্কান হিসেবে আপনাকে স্বাগত জানানো আমার জন্য সম্মানের। তবে এটা মাথা থেকে সরাতে পারছি না, আমরা যে তিনজন এরই মধ্যে এখানে আছি—আমি, সাঙ্গা (কুমার সাঙ্গাকারা) বা মুরালি (মুত্তিয়া মুরালিধরন), যে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করতেন, তাহলে আমরা সবাই একমত হতাম—আপনারই এখানে প্রথমে আসা উচিত ছিল।
আমরা সবাই আপনাকে দেখে বড় হয়েছি। আমরা সেই প্রজন্মের, যারা আপনার অর্জনে অনুপ্রাণিত। আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়া, ৯ বা ১০ বছর বয়সে আপনার অটোগ্রাফ নেওয়ার কথা মনে পড়ে। তখনো আপনি শ্রীলঙ্কা দলে নতুন, কিন্তু তার আগে থেকেই আপনি আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান। ছোটবেলায় আমরা সবাই আপনাকে অনুকরণ করতে চাইতাম, যেভাবে আপনি খেলতেন, তা দেখে।
আমাকে কোচরা বলতেন একটা নির্দিষ্টভাবে খেলতে, কিন্তু আপনি মানিয়ে নেওয়ার গুরুত্বটা দেখিয়েছিলেন। স্টান্স হোক বা ব্যাকলিফট, মনে হতো আপনি প্রতিনিয়ত সব বদলাচ্ছেন। তাল মেলানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল! কিন্তু এটা ছিল ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তার ইঙ্গিত, সৌভাগ্যক্রমে পরে যেটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার।
অবশ্যই আপনি ১৯৯৬ সালের সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যেবার ৩ উইকেট নেওয়ার সঙ্গে অসাধারণ সেই অপরাজিত সেঞ্চুরি করলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১৮ বছর বয়সে সেই সপ্তাহান্তে আমারও একটা বড় ফাইনাল ছিল, আমার সময়ে নালন্দা কলেজে শেষ আন্তস্কুল ‘বড় ম্যাচ’। দুই দিনের ওই উপলক্ষ অনেক বড় ব্যাপার ছিল। শনিবারে তো নিশ্চিতভাবেই চার-পাঁচ হাজার মানুষ এসেছিল। অবশ্য রোববারে আমাদের মা–বাবা আর প্রিফেক্টরা ছাড়া কেউই ছিল না। আপনি যে ফাইনালে খেলছিলেন, সেটিই দেখছিল বোধ হয় সবাই।
তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করে আমরা রান তাড়া দেখতে ছুটেছিলাম, টিভির সামনে আটকে ছিলাম। যখন আপনি এলেন, ২৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে আমরা ধুঁকছি। কিন্তু আপনার চোখে ওই অটল ভাবটা ছিল। সেমিফাইনালেও সেটি করে দেখিয়েছিলেন, ভারতের বিপক্ষে যখন আমরা ঝামেলায় ছিলাম। এরপর তাদের আক্রমণ লন্ডভন্ড করে দিলেন।
ফাইনালে কীভাবে আপনি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন, সব সময়ই মনে থাকবে আমার। ওই ড্রাইভ, ফ্লিক, পুল আর তৃতীয় উইকেট জুটিতে যেভাবে শেন ওয়ার্নকে সামলালেন! দুর্দান্ত! রাস্তায় গভীর রাত পর্যন্ত উৎসব করেছি আমরা, এখনো সেসব স্মৃতি লালন করি আমি।
আপনি এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি সময়ের চেয়ে এক প্রজন্ম এগিয়ে ছিলেন। অনেক আক্রমণাত্মক, ওই শ্রীলঙ্কা দলে অন্য যে কারও চেয়ে ফাস্ট বোলিং ভালো খেলতেন। অস্ট্রেলিয়ায় তারা সব সময়ই শ্রীলঙ্কাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করত, কিন্তু আপনার সঙ্গে পেরে উঠত না। সব সময় আপনি তাদের ওপর চড়াও হতেন।
অস্ট্রেলিয়ার ওই মানের বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ফাইনালে আপনার ইনিংসটি আমাদের প্রজন্মকে বিশ্বাস জুগিয়েছিল, আমাদের এই ব্র্যান্ডের ক্রিকেটই খেলতে হবে। যেটি আমরা পারিও। আপনি বিশ্বাস জুগিয়েছিলেন, আমরা বিশ্বের যে কাউকে হারাতে পারি।
এক বছর পর আপনার ও বিশ্বকাপজয়ী বাকিদের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুমে থাকা আমার জন্য ছিল অভিভূত হওয়ার মতো এক ব্যাপার। আমি পুরো মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।
টেস্ট অভিষেকের প্রথম দিন ড্রেসিংরুমে ঢুকে দেখলাম, সবার নিজস্ব জায়গা আছে। অপেক্ষা করছিলাম কোথায় আমার জন্য জায়গা বের হয়। ভাগ্যক্রমে আপনার দুটি জায়গা পর একটা চেয়ার ছিল। সে সময় থেকেই জানতাম, এই লোকের সঙ্গেই আমি ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনাকে প্রশ্ন করা, এর পর থেকে আপনার পরামর্শ নেওয়া—এগুলোই করেছি। আশা করি, আপনি সব সময় বিরক্ত হননি! আমার প্রথম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে যখন ৬ উইকেটে ৯৫২ রানের রেকর্ড স্কোর গড়লাম, সেটিতে আপনার সঙ্গে ব্যাটিং করাটা ছিল সম্মানের।
আপনাকে আদর্শ মেনে বড় হয়েছি, সেই আপনি আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন বলে অনেক কৃতজ্ঞ আমি। হয়তো সাঙ্গার সংখ্যা আপনার চেয়ে বেশি, কিন্তু আমাদের দুজনের যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই শুনবেন—আপনিই শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে আপনার প্রভাব অতুলনীয়, আপনিই আমাদের পথ দেখিয়েছেন।
আপনার সঙ্গে স্লিপ কর্ডনে থাকাটাও আমার জন্য শিক্ষা। সাধারণত আপনি প্রথম স্লিপে দাঁড়াতেন, ব্যাটসম্যান কীভাবে কী করছে, তা নিয়ে কথা বলতাম। আমার মনে পড়ে, কীভাবে আপনি তাদের দুর্বলতা আর আমাদের কোন বোলার আউট করবে, সেটি বর্ণনা করতেন। ভাসি (চামিন্ডা ভাস) বল ভেতরের দিকে ঢোকাত আর সেটিই হতো, যেমনটি আপনি বলেছিলেন। কী দারুণ একটা ব্যাপার!
অবশ্য আপনার ক্লাবের সতীর্থরা আপনার সঙ্গে এতটা উপভোগ্য সময় কাটিয়েছে কি না, সেটি ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারব না। নন্ডেস্ক্রিপ্টে একসঙ্গে থাকার সময় সাঙ্গা আপনার যেসব গল্প বলেছে, তা শুনে কতটা হেসেছিলাম, এখনো মনে পড়ে। সেটি হোক না প্রথম স্লিপে থাকতে আপনার জুতা খুলে ফেলা, যাতে অন্য কেউ কর্ডন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বলের পেছনে ছোটে অথবা পকেট থেকে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া—শুনে মনে হতো কখনোই নিরস মুহূর্ত কাটেনি। আমাদের সময়ের কথা থেকে আমি জোর গলায় বলতে পারি, পার্টি করার ব্যাপারে আপনার ধারেকাছেও যেতে পারব না! যদিও আমি দ্রুতই শিখেছিলাম!
অবশ্য মাঠে যখন জাতীয় দায়িত্ব পালনের সময় আসত, নিঃসন্দেহে আপনার চেয়ে সিরিয়াস কেউ ছিল না। আমরাই আসলে প্রথম প্রজন্ম, যারা ওই ফিটনেস সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি। মনে পড়ে, খেলা সব সময় বদলাচ্ছে বলে আপনি এর গুরুত্ব আমাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন।
আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পাওয়া আপনার প্রাপ্য। আমি সত্যিই গর্বিত, এখন শ্রীলঙ্কার পতাকা তুলে ধরতে এখানে আমরা চারজন। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট লোকগাথায় আপনার জায়গা পাকা। মাঠে এবং মাঠের বাইরে আমার ক্যারিয়ারে আপনি কতটা প্রভাব রেখেছেন, তার জন্য আসলে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই।
অভিনন্দন, আমার বন্ধু।
মাহেলা।