সাকিব আল হাসান কি তবে চোট লুকিয়ে খেলছেন? এর আগে বিভিন্ন সময়ে যে ক্রিকেটার অন্যদের চোট লুকিয়ে খেলা বা চোট নিয়ে খেলার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন, এখন নাকি তিনিই সেই কাজ করছেন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রকম অভিযোগের তিরই ছোড়া হচ্ছে সাকিবের দিকে।
এমন আলোচনার সূত্রপাত আসলে আজ চেন্নাইয়ে, বাংলাদেশ–ভারত প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিনে চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে। যদিও সত্যিটা হলো, সাকিব চোট লুকিয়ে খেলছেন না, সম্প্রতি তাঁর কোনো অস্ত্রোপচারও হয়নি, তিনি এই মুহূর্তে চোট আক্রান্তও নন। প্রথম ইনিংসে তাঁর বোলিংয়ে দেরিতে আসার কারণও আঙুলের সমস্যা নয়। তাহলে ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে কীভাবে ছড়াল কথাটা?
যাঁরা আজ টেলিভিশনে খেলা দেখেছেন, তাঁদের তা অজানা থাকার কথা নয়। যাঁরা খেলা দেখেননি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অলনাইন মিডিয়ার সূত্রে তাঁদেরও বিষয়টা জেনে যাওয়ার কথা। আজ শনিবার তৃতীয় দিনের খেলার শুরুতে ধারাভাষ্যকার মুরালি কার্তিক মাঠে নেমে কথা বলেছেন সাকিবের সঙ্গে। ধারাভাষ্য কক্ষে ফিরে ভারতের সাবেক এই বাঁহাতি স্পিনার সে কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী কারণে সে কম বোলিং করছে...সে আমাকে যা বলেছে, তা একজন স্পিনার হিসেবে আমিও বুঝতে পারছি।’
মুরালি কার্তিক এরপর বলেন, ‘তার (সাকিবের) বাঁ হাতের স্পিনিং ফিঙ্গারে একটা অস্ত্রোপচার হয়েছে। জায়গাটা এখন ফুলে গেছে, শক্ত হয়ে আছে। ওই আঙুলে সে বলের অনুভূতিটাও পাচ্ছে না। স্পিনার হিসেবে বলের অনুভূতিটা দরকার। এ ছাড়া তার কাঁধেও অস্বস্তি আছে।’
পরে নিজের পালায় ধারাভাষ্য দিতে এসে মুরালির কথার প্রসঙ্গ টেনেছেন এই সিরিজে ধারাভাষ্যকার হিসেবে থাকা বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালও। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘মুরালি কার্তিক বলে গেছেন, আঙুলের সমস্যার কারণে সাকিব বল গ্রিপ করতে পারছে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশ চারজন ফ্রন্টলাইন বোলার নিয়ে খেলছে। টিম ম্যানেজমেন্টের অবশ্যই জানানো উচিত, তারা এই ইনজুরির কথাটা আগে থেকেই জানত কি না।’
তামিমের কথার মধ্যে সাকিবের প্রতি সন্দেহটা পরিষ্কার—তিনি চোট লুকিয়ে খেলছেন না তো! এমনকি সাকিবকে যেন এই টেস্টে বোলার হিসেবেই ধরতে চাইলেন না তামিম। মূলত তাঁর এই মন্তব্যই পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডালপালা মেলে আরও ভাসমান হয়েছে। যদিও দলের একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে, মুরালির সঙ্গে ‘আনঅফিশিয়াল’ আলোচনায় সাকিব বলেননি যে তিনি বর্তমানে চোটে ভুগছেন। সাকিব এমনও বলেননি যে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর আঙুলে কোনো অস্ত্রোপচার হয়েছে। সেটা হলে অবশ্য পাকিস্তান সিরিজের পর কাউন্টি ক্রিকেটে গিয়েও অত দাপটের সঙ্গে বোলিং করে আসতে পারতেন না তিনি। দলের সূত্রের তাই দাবি, সাকিবকে নিয়ে তামিমের সন্দেহটি ‘অমূলক’।
চেন্নাই থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সাকিবকে প্রথম ইনিংসে দেরিতে বোলিংয়ে আনার কারণ তাঁর আঙুলের সমস্যা নয়। সাকিবও অধিনায়ককে বলেননি যে তিনি বোলিং করতে চান না বা দেরিতে বোলিং করতে চান।
সাকিবের আঙুলে সর্বশেষ অস্ত্রোপচার হয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ থেকে চোট নিয়ে ফেরার পর। ২০২৩ বিশ্বকাপেও তিনি চোট পেয়েছিলেন আঙুলে, বাঁ হাতের তর্জনীতে সূক্ষ্ম ফাটলও ধরেছিল। তবে তার জন্য তাঁকে অস্ত্রোপচার করাতে হয়নি। প্রথম আলোকে বিষয়টা নিশ্চিত করেছেন বিসিবির চিকিৎসক দেবাশিষ চৌধুরীও।
তাহলে মুরালিকে সকালে সাকিব এমন কী বলেছিলেন, যা এভাবে বিভ্রান্তিকর বার্তা ছড়িয়ে দিল?
চেন্নাই থেকে বাংলাদেশ দলের একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, মুরালির সঙ্গে আলোচনায় সাকিব কোনো সাল উল্লেখ না করেই বোঝাতে চেয়েছেন, ২০১৮ সালের ওই অস্ত্রোপচারের পর থেকে মাঝেমধ্যে তাঁর বল গ্রিপ করতে সমস্যা হয়। তবে সে জন্যই চেন্নাই টেস্টে বোলিং কম করছেন, এমন কিছু তিনি বলেননি। মুরালি নিজেই হয়তো আলোচনার অনুবাদটা সেভাবে করে নিয়েছিলেন।
মুরালির কৌতূহলের কারণটা পরিষ্কার। একে তো তিনিও বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন, তার ওপর এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাকিব বোলিংয়ে আসেন ৫৩তম ওভারে। ৮ ওভারে ৫০ রান দিয়ে থেকেছেন উইকেটশূন্য। পরের ইনিংসে আজ তৃতীয় দিনের শেষ পর্যন্ত ১৩ ওভারে ৭৯ রান দিয়েছেন, উইকেট পাননি এখনো। এই ইনিংসে যদিও বোলিংয়ে এসেছেন দশম ওভারে।
চেন্নাই থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সাকিবকে প্রথম ইনিংসে দেরিতে বোলিংয়ে আনার কারণ তাঁর আঙুলের সমস্যা নয়। সাকিবও অধিনায়ককে বলেননি যে তিনি বোলিং করতে চান না বা দেরিতে বোলিং করতে চান। সাকিবকে দেরিতে বোলিংয়ে আনার মূল কারণ, ওই সময় দলে পেস বোলারদের সঙ্গে অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজও ভালো বোলিং করছিলেন। অফ স্পিনে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতার কারণে অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের মনে হয়েছিল, তখনই বাঁহাতি স্পিনার সাকিবকে বোলিংয়ে আনার প্রয়োজন নেই। মূলত অধিনায়ক প্রয়োজন মনে করেননি বলেই প্রথম ইনিংসে অত দেরিতে (৫৩তম ওভার) সাকিবের বল হাতে নেওয়া বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।
অবশ্য এটাও ঠিক যে বাঁ হাতের আঙুলে ২০১৮ সালের ওই অস্ত্রোপচারের পর থেকে চোট পাওয়া আঙুলটা মাঝেমধ্যে সমস্যায় ফেলে সাকিবকে। সিরিজ চলছে বলে দলের কেউ বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও দল–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, সাকিবের নতুন কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। তবে ২০১৮ সালের অস্ত্রোপচারের পর থেকে তিনি আঙুলের সমস্যা ‘ম্যানেজ’ করেই খেলছেন। যা টিম ম্যানেজমেন্টের অজানা নয়। তামিম দলে থাকার সময় তাঁরও তা অজানা থাকার কথা নয়। আর সব ক্রিকেটারকেই এ রকম ছোটখাটো কিছু চোটের সমস্যা ‘ম্যানেজ’ করে খেলতে হয়। ক্রিকেটে এটা নতুন কোনো আবিষ্কার নয়।
সাকিবের আঙুলের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সেবার দলের ফিজিওর উদাসীনতার অভিযোগ উঠেছিল। ঢাকায় ফিরে ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে অস্ত্রোপচার করানোর পরও সংক্রমণ জটিলতায় বেশ ভুগতে হয় তাঁকে।
অস্ত্রোপচারের দিন নিজের ভেরিফায়েড ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে হাসপাতালে শুয়ে থাকার একটি ছবি দিয়ে সাকিব লিখেছিলেন, ‘হাতের ব্যথায় যখন দল ছেড়ে দেশে ফিরছি, তখনো বুঝতে পারিনি এত খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। দেশে আসার পর প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব ও হাত অস্বাভাবিক রকম ফুলে যাওয়ায় দ্রুত হসপিটালে অ্যাডমিট হয়ে একটি সার্জারি করাতে হয়েছে। আঙুলের ভেতর ইনফেকশনের ফলে ৬০-৭০ সেন্টিমিটার পুঁজ বের করতে হয়েছে। আপনাদের দোয়ায় খুব অল্পের জন্য বড় ধরনের বিপদ থেকে এই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছি, তবে দ্রুতই আরও একটি সার্জারি করাতে হবে। আপনাদের সবার দোয়া প্রার্থনা করছি। আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসায় দ্রুত সুস্থ হয়ে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি। ধন্যবাদ..।’
তবে সংক্রমণ জটিলতায় পরের মাসেই চিকিৎসার জন্য সাকিবকে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গ্রেগ হয়ের কাছে। মেলবোর্নের হাসপাতালে সাকিবকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখেন চিকিৎসক। এরপর জানা যায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে সাকিব তত দিনে এটাও জেনে গিয়েছিলেন যে তাঁর ওই আঙুলটা আগের অবস্থায় না–ও ফিরতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁকে খেলা চালিয়ে যেতে হবে ‘ম্যানেজ’ করে।
২০১৮ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে নভেম্বরেই সাকিব মাঠে নামেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সমস্যাটা ‘ম্যানেজ’ করেই খেলে যাচ্ছেন, যেটা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ দেখছেন না বাংলাদেশ দলে সাকিবের সতীর্থরাও।
তবে ভুল–বোঝাবুঝির সূত্রপাত মুরালি কার্তিকের ওই কথাটা থেকেই। আরও ভেঙে বললে সাকিবের কথা বুঝতে তাঁর ভুল করা।