বাংলাদেশ সময় আগামীকাল সকালে ডালাসে শুরু হবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
বাংলাদেশ সময় আগামীকাল সকালে ডালাসে শুরু হবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

উৎপল শুভ্রর লেখা

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপ ও ৩০ বছর আগের সেই স্মৃতি

ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে কালো রঙের চারটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। তিনজন দাঁড়িয়ে, একজন বেঞ্চে বসে। বেসবল থেকে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত এই স্টেডিয়ামকে ধরা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের নতুন যুগের সূচনার কেন্দ্রবিন্দু। এর বাইরে তাই ক্রিকেটারদের ভাস্কর্য থাকতেই পারে। বাহ্, এই না হলে আমেরিকা! কত তাড়াতাড়ি স্টেডিয়ামের নতুন পরিচয় লেখা  হয়ে গেছে! মনে চরম কৌতূহল, ভাস্কর্য বানাতে কাদের বেছে নেওয়া হয়েছে, কোন চার ক্রিকেটার? ক্রিকেটার তো বটেই, দাঁড়িয়ে থাকা একটি মূর্তির হাতে হেলমেটও দেখা যাচ্ছে।

একটু কাছে যেতেই ভুল ভাঙল। ক্রিকেটের সঙ্গে এই চতুষ্টয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে কি এঁরা বেসবলের কোনো বিখ্যাত চার? না, বেসবলও নয়। চারজনই বৈমানিক। যাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ডালাসের বিমানচালনা বিদ্যার বিখ্যাত ইতিহাসকে। একজনের হাতে মিনিয়েচার উড়োজাহাজটা দূর থেকে চোখে পড়েনি। তা দেখে যে সন্দেহটা হয়েছিল, তা দূর হয়ে গেল পাশেই লম্বা একটা ফলকে লেখাগুলো দেখে। স্টেডিয়ামের বাইরের এই ভাস্কর্যের সঙ্গে কোনো খেলারই কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে বিমানচালনার।

কিন্তু স্টেডিয়াম—তা বেসবলের হোক বা ক্রিকেটের—এর বাইরে চার বৈমানিকের ভাস্কর্য কেন থাকবে? অবধারিত এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কাউকে পেলে তো! মার্কিন মুলুকে ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপ শুরুর তিন দিন আগে চলছে স্টেডিয়ামকে সাজিয়ে তোলার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। খুটখাট আওয়াজ, ব্যস্তসমস্ত হয়ে মাঠকর্মীদের ছোটাছুটি। এঁদের কারও কাছে এই ধাঁধার উত্তর আছে বলে মনে হয় না।

প্রথম দুটি বিশ্বকাপ ভারত আর পাকিস্তানের। এরপর আর তাদের কোনো খবর নেই। পরের ৬টি বিশ্বকাপ জিতেছে ৪টি দল। সর্বশেষবার জিতে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গী হয়েছে ইংল্যান্ড।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রিকেট হারিয়ে যাওয়াটাও একই রকম ধাঁধা। সপ্তদশ শতকের শেষে শুরু হয়ে আরও বেশ অনেক দিন আমেরিকানদের প্রিয় খেলার নাম তো ক্রিকেটই ছিল। ফিলাডেলফিয়া হয়ে উঠেছিল ক্রিকেটের সবচেয়ে উর্বর ভূমিগুলোর একটি। ক্রিকেট ভুলে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমশ ​‘বেসবলের দেশ’ হয়ে ওঠার কারণটা গবেষকদের প্রিয় এক বিষয় হতে পারে।

২.

বিশ্বকাপের ক্রোড়পত্রে জরুরি একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটাকে রীতি বলতে পারেন। প্রশ্নটা খুব সরল—কে জিতবে বিশ্বকাপ? সরল এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা যে কত কঠিন, তা মনে হয় আপনিও জানেন। টি-টোয়েন্টি চমক দিতে ভালোবাসে। সেই টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপের স্বভাব কি আর ভিন্ন কিছু হতে পারে!  

যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট দল। প্রথমবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলবে তাঁরা।

শুরুটাই তো চমক দিয়ে। সেই চমকের কথা বলার আগে অতি আবশ্যকীয় একটু ভূমিকা করে নিই। যা এর আগেও লিখেছি বলেই মনে পড়ছে। লিখলে লিখেছি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এলে আবারও তা মনে করিয়ে দেওয়াটা কর্তব্যের পর্যায়েই পড়ে।

কথাটা এখন কারও অবিশ্বাস্য বলে মনে হতেই পারে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ধারণাটাকে শুরুতে ভারত একদমই পছন্দ করেনি। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যভূমি তখন ওয়ানডেতে মজে। ইংল্যান্ড উদ্ভাবিত টি-টোয়েন্টি অপছন্দ করার কারণটাও খুব অনুমেয় ছিল। টি-টোয়েন্টিতে ২০-২০ চল্লিশ ওভার। ওয়ানডেতে যেখানে ৫০-৫০ এক শ। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ আড়াই গুণ বেশি। সহজ হিসাবে ওয়ানডের বদলে টি-টোয়েন্টি খেলা মানে তো টেলিভিশন বিজ্ঞাপন থেকে আয় আড়াই শ ভাগ কমে যাওয়া। ভারতের জাতীয় দল এক দিনে তো সর্বোচ্চ একটা ম্যাচই খেলতে পারে। বাণিজ্যের কথা ভাবলে তাই ওয়ানডে খেলাই ভালো। টি-টোয়েন্টির প্রতি এই বিতৃষ্ণা থেকে ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের তারকা খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দিয়ে তরুণ এক দল পাঠিয়ে দেয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। যে দলের অধিনায়কও তরুণ। মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে সেই দলই যে শিরোপা জিতে ফেলে, এটা তো আপনার জানা না থাকার কোনো কারণই নেই।

পরের বছরই আইপিএলের জন্মের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র কেউ খুঁজে পেতেই পারেন। তরুণ ধোনির তরুণ ওই দলের চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আইপিএল মিলিয়ে ক্রিকেট আর আগের মতো থাকেনি। এর আগের শত বছরের ইতিহাসের সঙ্গে যেটির এমনই অমিল যে মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো অনেকেরই খেলাটাকে এখন অচেনা বলে মনে হয়।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ধোনির ভারত

চমকের এই ধারা বজায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার জেরে পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তখন নির্বাসিত। দুবাই-আবুধাবি-শারজাকে হোমগ্রাউন্ড বানিয়ে খেলাটা তখনো নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়নি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগবঞ্চিত সেই পাকিস্তানই সবাইকে চমকে দিয়ে ইংল্যান্ডের সেই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন! ইউনিস খান সেই দলের অধিনায়ক বলে চমকটাতে আরও বীররস যুক্ত হয়। ইউনিসের শহর পেশোয়ার তখন একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত। তাঁর হাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফিটা তাই বাড়তি ব্যঞ্জনা পেয়েছিল। ফাইনাল জেতার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে নাটকীয়তাও যোগ করেছিলেন ইউনিস।

প্রথম দুটি বিশ্বকাপ ভারত আর পাকিস্তানের। এরপর আর তাদের কোনো খবর নেই। পরের ৬টি বিশ্বকাপ জিতেছে ৪টি দল। সর্বশেষবার জিতে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গী হয়েছে ইংল্যান্ড। এসব অবশ্য এত ঘটা করে বলার কিছু নেই। হয়তো আপনার তা জানাই ছিল। 

৩.

যা অনেকেরই জানা নেই বলে অনুমান করি, তা হলো, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যুক্তরাষ্ট্রে খেলার পুরোনো ইতিহাস। না, ২০১৮ সালের কথা বলছি না। যদিও সেটিই প্রথম মনে হওয়া স্বাভাবিক। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ দুটি ম্যাচ বাংলাদেশ খেলেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ফ্লোরিডার লডারহিলের ওই দুই ম্যাচ জিতে জিতেছিল সিরিজও। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের স্মরণীয়তম সাফল্যের কথা বলতে গেলে ২০২৩ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পাশে এটিকেও রাখতে হয়।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ

এই স্মৃতি বেশি দিন আগের নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে খেলার পুরোনো যে ইতিহাসের কথা বলছিলাম, তা আসলেই অনেক পুরোনো। নির্দিষ্ট করে বললে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। ১৯৯৪ সালের জুন-জুলাইয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাশের দেশ কানাডাও ছিল। যে সফরের শুরু বিতর্ক দিয়ে, শেষটাও তা-ই। শুরুর বিতর্ক প্রীতি ম্যাচের সেই সফরের দলে পাঁচজন কর্মকর্তার উপস্থিতি নিয়ে। কোচ হিসেবে ছিলেন বর্তমান প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন।

তা কোচ তো একজন লাগবেই; তাই বলে শেফ ডি মিশন, প্রশাসনিক ম্যানেজার, ট্যুর ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার...এমন গালভারী নাম দিয়ে আরও চারজন! বিসিসিবি (তখন বিসিবির এই নামই ছিল) থেকে অবশ্য বলা হয়েছিল, শেফ ডি মিশন হিসেবে আফজালুর রহমান সিনহাকে রাখা হয়েছে, কারণ সফরের খরচ অনেকটা তিনি দেবেন। সপরিবার যাওয়াটা তো অবশ্যই নিজের খরচে। তারপরও সমালোচনা হচ্ছে দেখে আফজালুর রহমান সিনহা নিজেকে সরিয়ে নেন, তাঁকে অনুসরণ করেন প্রশাসনিক ম্যানেজার দেওয়ান শফিউল আরেফিনও। 

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার জাতীয় দলের বাইরেও গায়ানিজ একাদশ, সম্মিলিত একাদশ এমন সব বিচিত্র দলের সঙ্গে খেলেছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ম্যাচ ‘টাই’ হয়েছিল, কানাডায় টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট ক্লাব একাদশের কাছে হারতে হয়েছিল ৬ রানে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম তখন এখনকার মতো ক্রিকেটময় হয়ে না উঠলেও পত্রপত্রিকায় যথেষ্টই সমালোচনা হয়েছিল। তবে শেষের যে বিতর্ক, তা ফলাফলকেন্দ্রিক নয়। সেই বিতর্ক দলের চার সিনিয়র খেলোয়াড় মিনহাজুল আবেদীন, আতহার আলী খান, ফারুক আহমেদ ও এনামুল হক দলের সঙ্গে দেশে না ফেরায়।

বোর্ডের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে তাঁরা ছুটি কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যান। চারজনকেই চার সপ্তাহের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধান্তটা খুব সহজ ছিল না। কারণ, এই সময়ের মধ্যেই পড়েছিল এশিয়া কাপের কোয়ালিফাইং টুর্নামেন্ট এসিসি ট্রফি। বোর্ডের অনড় অবস্থানের কারণে দলের গুরুত্বপূর্ণ চার খেলোয়াড়কে বাদ দিয়েই যে টুর্নামেন্টে খেলতে যায় বাংলাদেশ। শৃঙ্খলার ব্যাপারে ক্রিকেট বোর্ড তখন কেমন কঠোর ছিল, তা ভেবে এখন একটু অবাকই লাগে।

এই ঘটনার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তা বললাম কেন? বাংলাদেশ দলকে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে দেখে পুরোনো সেই স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায়। বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে যেমনই করুক, এবার অন্তত অমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।