বিরাট কোহলি অহর্নিশ বলেন, তাঁর কাছে টেস্ট ক্রিকেটই সবার ওপরে। আইপিএলের রোশনাই, সীমিত ওভারে ভারত ক্রিকেটের এ যুগের সবচেয়ে বড় তারকার কাছে দিনের শেষে টেস্ট ক্রিকেটের বিশেষ মর্যাদাই থাকে।
কোহলি তিন সংস্করণেই খেলেন বলে ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে। টানা সূচির মাঝে বিশ্রাম খুঁজে নিতে হয়। তাই হয়তো ২০১২ সালের পর ঘরোয়া কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেননি।
প্রায় একই অবস্থা সাকিব আল হাসানেরও। ২০১৫ সালের পর লাল বলে ঘরোয়া কোনো ম্যাচ খেলেননি বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। কোহলি ক্যারিয়ারে কখনো কাউন্টি ক্রিকেট খেলেননি। ২০১০ ও ২০১১ সালে উস্টারশায়ারের হয়ে দীর্ঘ সংস্করণে ইংল্যান্ডে খেলেছিলেন সাকিব।
কোহলি ও সাকিবদের কাছে টেস্ট ক্রিকেট যে এখনো মর্যাদা ও আগ্রহের ব্যাপার, এক অর্থে প্রায়ই ‘এর কী হবে’ রব ওঠা এই সংস্করণের দারুণ একটি বিজ্ঞাপনই। বিশেষ করে তাঁদের নিজ নিজ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
অবশ্য চেতেশ্বর পূজারা বা মুমিনুল হকের কাছে টেস্ট ক্রিকেটই এক অর্থে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবকিছু! তবে কাল চট্টগ্রাম টেস্টে নিজ নিজ দলে থাকলে দুজন নামবেন ভিন্ন দুই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে।
****
ওয়ানডে সিরিজের ঠিক পরদিন ভারতের অনুশীলনও ছিল ঐচ্ছিক। পূজারাকে দেখা গেল সেখানেই। নেটে ব্যাট করলেন, পরে শুবমান গিলদের সঙ্গে স্লিপ ক্যাচিং অনুশীলনও সেরে নিলেন। ভারতের হয়ে পূজারা সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছেন গত জুলাইয়ে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এজবাস্টন টেস্টে।
পাঁচ ওয়ানডের ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ম্যাচটি পূজারা খেলেছেন সেই ২০১৪ সালে। এখন তিনি ভারতের হয়ে খেলেন শুধু দীর্ঘ সংস্করণের ক্রিকেটই। কাল চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাওয়া ম্যাচে খেললে সেটি হবে পূজারার ৯৭তম টেস্ট।
শুধু টেস্ট দলে থাকলেও উমেশ যাদবের সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে আগেভাগেই এসেছেন পূজারা। উদ্দেশ্য ছিল ‘এ’ দলের হয়ে দ্বিতীয় চার দিনের ম্যাচটি খেলা। একমাত্র ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে পূজারা ফিফটি করেন।
এক সংস্করণের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় বলে পূজারাকে মাঠে থাকতে হলে নিয়মিত খেলতে হয় ঘরোয়া ক্রিকেট। জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই টেস্টের আগে থেকেই সাসেক্সের হয়ে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ, এক দিনের রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপে খেলেছেন।
কাউন্টিতে পূজারার সময়টা কেটেছে স্বপ্নের মতোই। দীর্ঘ সংস্করণে ১৩ ইনিংসে ১০৯.৪০ গড়ে করেছেন ১০৯৪ রান, আছে ৫টি সেঞ্চুরি। এরপর সাদা বলেও ৯ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরিতে করেছেন ১১১.৬২ গড়ে ৬২৪ রান। পূজারা এরপর ভারতে বিজয় হাজারে ট্রফিতে খেলেছেন এক দিনের ম্যাচ, খেলেছেন টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতেও। রানের দেখা পেয়েছেন সবখানেই।
চট্টগ্রাম টেস্টে পূজারা তাই নামবেন ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
ক্যারিয়ারের দিক থেকে মুমিনুলের অবস্থা পূজারার মতোই। ২৮ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে শেষটি খেলেছেন ২০১৮ সালে। টেস্টে বাংলাদেশ ইতিহাসের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি তাঁর। এক সিরিজ আগেও এই সংস্করণে দলের অধিনায়ক ছিলেন।
এ বছরের শুরুতে মাউন্ট মঙ্গানুইতে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ে ৮৮ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস ছিল তাঁর। কিন্তু এরপরই বদলে গেল চিত্রটা। মুমিনুল হারিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন নিজেকে। এরপর থেকে সর্বশেষ ১১ ইনিংসে কোনো ফিফটি নেই, সর্বশেষ ১০ ইনিংসে দুই অঙ্কই ছুঁতে পারেননি।
ফল—সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে বাদ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের পর জাতীয় দলের বাইরে মুমিনুল খেলেছেন বিপিএল (পূজারা সেখানে আইপিএলে সুযোগ পান না বলেই চলে), ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় ক্রিকেট লিগ, ‘এ’ দলের হয়ে তামিলনাড়ু সফর, বিসিএলে ৫০ ওভারের সংস্করণ ও ‘এ’ দলের হয়ে ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচের সিরিজে।
তবে মুমিনুল সেভাবে রানের দেখা পাননি। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের পর সব সংস্করণ মিলিয়ে মুমিনুলের ফিফটি আছে দুটি—‘এ’ দলের হয়ে তামিলনাড়ু সফরের পর জাতীয় ক্রিকেট লিগে আরেকটি। সর্বশেষ ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষেও নিষ্প্রভ ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট দলে মুমিনুলের থাকার খবরও তাই আসে এমন শিরোনামে—জায়গা ধরে রাখলেন মুমিনুল।
আজ সংবাদ সম্মেলনে মুমিনুলের সঙ্গে অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত শুধুই টেস্ট খেলা মাহমুদুল হাসান জয়ের ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁদের এক সংস্করণে খেলার ব্যাপারটিকেই ঢাল হিসেবে দাঁড় করাতে চাইলেন বাংলাদেশের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো, ‘মুমিনুল ও জয় (মাহমুদুল) শেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে ছয় মাস আগে। এক সংস্করণ খেলার এটিই চ্যালেঞ্জ। সাকিব ও লিটন প্রতি সপ্তাহেই খেলছে, এটা তাদের জন্য খুব একটা ব্যাপার নয়।’
তবে ডমিঙ্গো জানেন, দিন শেষে বিচারটা হবে রানের সংখ্যাতেই। যেখানেই পিছিয়ে মুমিনুলরা। তবে এবার নেটে তাঁদের দেখে নাকি ভালোই মনে হয়েছে তাঁর, ‘মুমিনুল ও জয় (মাহমুদুল) যেভাবে খেলছে, সেটিই ভালোই। আমি জানি রানের মূল্যই বেশি, তবে টেকনিক্যালি তাদের বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। জয় তো ভালো শুরুও পেয়েছে অনেক, এখন শুধু ছন্দটা খুঁজে পেয়ে বড় স্কোর গড়ার ব্যাপার।’
*****
আন্তর্জাতিক বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালে খেলার ব্যাপারে তখন সীমিত ওভারের দলের বাইরে থাকা ভারত অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন বলেছিলেন, তাঁর বা পূজারার কাছে ম্যাচটি বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোই। যেহেতু এক সংস্করণেই খেলেন তাঁরা।
অশ্বিন অবশ্য এখন সীমিত ওভারেও সুযোগ পান। তবে পূজারা রয়ে গেছেন টেস্টেই, ঠিক যেমন মুমিনুল। চট্টগ্রাম টেস্ট তাই দুজনের জন্যই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মঞ্চে আরেকবার নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ।
পূজারা যেখানে আসছেন রানের পর রান করে। আর মুমিনুল খুঁজে ফিরছেন সেই ‘হারানো মানিক’—রান!
এমনিতে চট্টগ্রাম মুমিনুলের সবচেয়ে প্রিয় মাঠ। ১১টি সেঞ্চুরির ৭টিই করেছেন এ মাঠেই। মুমিনুল হয়তো নিজেও জানেন, ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের একাদশে থাকলে সেটি তাঁর জন্য বড় একটি সুযোগই হতে যাচ্ছে। যে সুযোগ হাতছাড়া করার মাশুলও হতে পারে চড়া।
যে সংস্করণে খেলেন, সেটিতেও পারফর্ম করতে না পারলে যে থাকে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও।