এই ভষ্মাধারের জন্যই লড়াই করে আসছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া
এই ভষ্মাধারের জন্যই লড়াই করে আসছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া

উৎপল শুভ্রর লেখা

‘দ্য ডেমন’-এর মুখে অ্যাশেজের জন্মকাহিনি

কী জিততে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট লড়াইয়ে নামে, জানেন তো? একটা ছাইদানি। ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরোনো দ্বৈরথের জন্মের ইতিহাসটাও খুব বিচিত্র। কেমন হয়, সেই ইতিহাসের স্রষ্টাদের মুখেই যদি শোনা যায়! বাস্তবে তো আর সম্ভব নয়, তবে কল্পনায় কী না হয়! কেমন হয়, কল্পলোকে যদি সেই গল্পটা বলেন স্বয়ং ফ্রেড স্পফোর্থ, যাঁর বিধ্বংসী বোলিংয়েই বীজ বোনা হয়েছিল অ্যাশেজের।

পূর্বকথা: স্বর্গে কিংবদন্তি সব ক্রিকেটারের আড্ডা হচ্ছে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের বিশেষ আগ্রহে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ফ্রেড স্পফোর্থকে। বিধ্বংসী বোলিংয়ের কারণে যাঁর ডাকনাম ছিল ‘দ্য ডেমন’। সেই ডেমনের বোলিংয়েই মাত্র ৮৫ রানের লক্ষ্যও ছুঁতে না পেরে হারার ঘটনা থেকে জন্ম ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্বৈরথ অ্যাশেজের। আরেকটি অ্যাশেজ সিরিজ শুরুর আগে গল্পে গল্পে সেই অ্যাশেজের জন্মের ইতিহাস।  

অ্যাশেজের গল্প বলার কথা ফ্রেড স্পফোর্থের। সেই উদ্দেশ্যেই স্পফোর্থকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। কিন্তু আড্ডা কি আর নিয়ম মেনে চলে! একথা-সেকথা অ্যাশেজ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলটি যিনি করেছিলেন, সেই আলফ্রেড শ-ই আবার প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনলেন সবাইকে, ‘আরে, ডন অ্যাশেজের গল্প শুনবে বলে অধীর অপেক্ষায় আছে। আর তোমরা এ–ডাল থেকে ও-ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছ! ওসব কথা পরে হবে। ফ্রেড আগে অ্যাশেজের গল্পটা বলুক।’

‘বলছি, বলছি’ স্পফোর্থ একটু আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ব্র্যাডম্যানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি রেজিনাল্ড ব্রুকসের নাম শুনেছ?’

ব্র্যাডম্যান অবাক হয়ে বললেন, ‘না তো, এই নামে কোনো ক্রিকেটারের কথা তো শুনিনি।’

স্পফোর্থ হাসলেন, ‘আমি কি বলেছি ক্রিকেটার? যে অ্যাশেজ নিয়ে তোমার এত আগ্রহ, সেটি কিন্তু হয়েছে ওই ব্রুকসের কারণে।’

ডব্লিউ জি গ্রেসের আবছা আবছা মনে পড়ছে নামটা। তাই আরও মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন স্পফোর্থের কথা, ‘১৮৮২ সালে ওভালের ওই টেস্টে আমরা, মানে অস্ট্রেলিয়ানরা ৭ রানে জিতেছিলাম। মাত্র ৮৫ রানের টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে ৭৭ রানেই অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ডক্টর একাই ৩২ করেছিল। আগের ইনিংসের মতো এবারও আমার ৭ উইকেট। কিন্তু তাতেই এই ম্যাচটা এমন বিখ্যাত হয়ে যেত না। হয়েছে ওই রেজিনাল্ড ব্রুকসের কারণে। নইলে ইংল্যান্ডকে হারানো আর এমন কী? এর আগের আট টেস্টের চারটিই তো আমরা জিতেছিলাম, ইংল্যান্ড জিতেছিল মাত্র দুটিতে।’

আড্ডায় ইংল্যান্ডের তিন ক্রিকেটার ডব্লিউ জি, শ ও লোহম্যান খোঁচাটা নীরবে হজম করলেন। কথা তো সত্যি।

কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে মুচকি হেসে স্পফোর্থ বলতে লাগলেন, ‘তবে হ্যাঁ, ওই জয়টা একটু বেশিই আনন্দের ছিল। এর আগে এত কম ব্যবধানে কোনো টেস্টের রেজাল্ট হয়নি। তা ছাড়া আমরা ফিল্ডিং করতে নামার সময়ই রাগে ফুঁসছিলাম। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর আগে আমিই ড্রেসিংরুমে বলেছিলাম, “দিস থিং ক্যান বি ডান।” আমাদের আসলে রাগিয়ে দিয়েছিল ডব্লিউ জি।’

‌দ্য ডেমন' ফ্রেড স্পফোর্থ: যাঁর কারণে অ্যাশেজের জন্ম

ডব্লিউ জির দিকে ঘুরে গেল সবার দৃষ্টি। তিনি দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মনোযোগ দিয়ে আকাশে উড়তে থাকা পাখি দেখতে শুরু করলেন।

একসময় যে ঘটনায় রাগে ফুঁসছিলেন, এত বছর পর সেটি বলার সময় স্পফোর্থের মুখে হাসি, ‘পাজিটা কী করেছিল জানো, ডন? আমাদের ক্যাপ্টেন বিলি মারডক শর্ট লেগের দিকে একটা বল খেলে সিঙ্গেলের জন্য দৌড় দিলেন। ইংল্যান্ডের উইকেটকিপার আলফ্রেড লিটেলটন সামনে দৌড়ে গিয়ে বলটা হাতে নিতে নিতে রান হয়ে গেল। নন স্ট্রাইকার স্যামি জোন্স ক্রিজে পৌঁছে গেছে। লিটেলটন গ্লাভস খুলে বলটা ডব্লিউ জিকে থ্রো করেছিল। স্লিপ থেকে ও তখন উইকেটের পেছনে। জোন্স ভেবেছে, রান তো কমপ্লিট হয়েই গেছে, বল এখন ডেড। উইকেটের একটু সামনে গিয়ে ও ব্যাট দিয়ে পিচ ঠুকতে শুরু করল, ওই যাকে বলে গার্ডেনিং। আর ডক্টর বেলস ফেলে দিয়ে আপিল করে বসল। আম্পায়ারের তো আউট না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। পরের ব্যাটসম্যান ছিলাম আমি। রাগে গজরাতে গজরাতে নেমেছিলাম। সে কারণেই হয়তো শূন্য রানেই আউট হয়ে গেলাম।’

ডব্লিউ জি এতক্ষণে একটা পাল্টা নেওয়ার সুযোগ পেলেন, ‘অজুহাত দিয়ো না। আমি অমন না করলেও তুমি ডাকই মারতে। তুমি ব্যাটিং পারতে নাকি?’

স্পফোর্থ কি আর দমার পাত্র! ঠিকই জবাব দিলেন, ‘কী বললে? তুমি জানো, টেস্টে আমার ফিফটি আছে? টেস্টে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যানের প্রথম ফিফটি ওটি। পরের ২১ বছর সেটি একমাত্রও হয়ে ছিল।’

আড্ডায় যাঁরা আছেন, তাঁদের আর কেউই ১৮৮৫ সালে মেলবোর্নের ওই টেস্টে ছিলেন না। তবে ইতিহাসের প্রথম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান চার্লস ব্যানারম্যান ছোট ভাই অ্যালেকের কাছে সেই টেস্টের গল্প শুনেছেন। অ্যালেক খেলেছেন ওই টেস্টে। তাঁর কাছ থেকে শোনা গল্পটাই মিলিয়ে নিতে চাইলেন চার্লস ব্যানারম্যান, ‘ফ্রেড, ওই টেস্টে নাকি আম্পায়ার ছিল সাতজন?’

আলফ্রেড শ: টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বলটি করেছিলেন যিনি

‘ঠিকই শুনেছ। সে এক মজার কাহিনি। মাঠে অবশ্য সাতজন নামেননি। যে দুজনের আম্পায়ারিং করার কথা ছিল, তাঁদের একজন টেস্টের আগে হঠাৎ মারা গেলেন। আরেকজন কী কারণে যেন বেঁকে বসলেন। তাঁদের বদলি হিসেবে ঠিক করা হলো জর্জ হজেস ও জিম ফিলিপসকে। ইংলিশ খেলোয়াড়েরা আম্পায়ারদের খুব গালাগালি করছিল, এর প্রতিবাদে হজেস মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিলিপস অবশ্য যাননি। তাঁর সঙ্গে আম্পায়ারিং করার জন্য খুঁজেটুজে তিনজনকে বের করা হলো। ম্যাচের বিভিন্ন সময় ওই তিনজন আম্পায়ারিং করলেন। অদ্ভুত ঘটনা, আর কোনো টেস্টে এমন হয়েছে বলে মনে হয় না। আম্পায়ারের কথা যখন উঠল, আরেকটা অদ্ভুত ঘটনাও তোমাদের বলি। সিডনিতে আগের টেস্টে আম্পায়ারিং করা “প্যাডি” ম্যাকশেনের এই টেস্টে অভিষেক হয়ে গেল।’

ব্র্যাডম্যান শুনতে শুনতে ভাবছিলেন, কী বিচিত্রই না এই ক্রিকেট খেলাটার ইতিহাস! চাইলে প্রতিদিনই নতুন কিছু শোনা যায়। স্পফোর্থকে অ্যাশেজে ফেরাতে বললেন, ‘আপনি রেজিনাল্ড ব্রুকসের কথা যেন কী বলছিলেন?’

‘ও হ্যাঁ, বলছিলাম, যে অ্যাশেজ নিয়ে এত মাতামাতি, সেটি ওই রেজিনাল্ড ব্রুকসেরই অবদান। আমরা তো ওই টেস্ট জিতে রাতে পার্টিটার্টি করে ভোরবেলায় ঘুমিয়েছি। পরদিন মহা হইচই। ক্রীড়া সাপ্তাহিক স্পোর্টিং টাইমসে নাকি ইংলিশ ক্রিকেটের অবিচ্যুয়ারি ছাপা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইংলিশ ক্রিকেটকে দাহ করে সেটির ছাই অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। দাঁড়াও, দাঁড়াও, ওই পেপার কাটিংটা আমি রেখে দিয়েছিলাম। প্রায়ই তা বের করে দেখতাম। দেখতে দেখতে সেটি আমার মনে গেঁথে গেছে। একটা কাগজ-কলম দাও, আমি একেবারে হুবহু সেটি তৈরি করে তোমাদের দেখাচ্ছি।’

ডব্লিউ জি বললেন, ‘আমারও এখনো সেটি চোখে ভাসে। ওই টেস্টের আগে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, আর খেলব না। গ্রামে চলে যাব, ডাক্তারিতে মন দেব। ওই অবিচ্যুয়ারিটা দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল। ঠিক করলাম, প্রতিশোধ না নিয়ে বিদায় নেব না।’

‘স্পোর্টিং টাইমস’-এ ছাপা হওয়া এই সেই অবিচুয়ারি

লোহম্যানের পকেটে সব সময়ই কাগজ-কলম থাকে। প্রায়ই আপনমনে কী যেন আঁকিঝুঁকি করেন। স্পফোর্থকে তা বের করে দিলেন। ডব্লিউ জি অবাক হয়ে দেখলেন, স্পফোর্থ যেন ঠিক সেদিনের পত্রিকার ওই অংশটা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।
ঝুঁকে পড়ে তা দেখতে দেখতে ব্র্যাডম্যান ভাবছিলেন, রেজিনাল্ড ব্রুকস রহস্যের সমাধান তো এখনো হলো না।

যেন তাঁর মনের কথা পড়েই স্পফোর্থ বললেন, ‘এই ব্যঙ্গ অবিচ্যুয়ারিটা লিখেছিল রেজিনাল্ড ব্রুকস। ও ছিল সাংবাদিক ও লেখক। স্পোর্টিং টাইমসে কাজ করত। ওর আরেকটা পরিচয়, পাঞ্চ নামে ওই বিখ্যাত ব্যঙ্গ ম্যাগাজিনের সম্পাদক শার্লি ব্রুকসের ছেলে। পাঞ্চেও অনেক লিখেছে। ওই অবিচ্যুয়ারি লেখার ছয় বছর পর মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই ও মারা যায়।’ ব্র্যাডম্যান অস্ফুটে বললেন, ‘মরার আগে একটা কাজ করে গেছেন বটে!’