এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুবাদে আপনিও নিশ্চয়ই এখন জেনে গেছেন যে একসময় আমেরিকায় ক্রিকেটের খুব রমরমা ছিল। যদিও সেটি অনেক অনেক দিন আগের কথা। যেদিন আর কখনো ফিরবে বলে মনে হয় না।
তা আধুনিক ক্রিকেটেও কি আমেরিকার অবদান নেই? একটু অন্যভাবে হলেও আছে। ক্রিকেটের ১ নম্বর ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর ধারণাটা তো এসেছিল এক আমেরিকানের মাথা থেকেই। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইমন কিংয়ের কেন মনে হয়েছিল, ক্রিকেটের লাইভ স্কোর দিয়েই একটা ওয়েবসাইট করা যায়, তা নিয়ে অন্য কোনো সময় কথা বলা যাবে। আপাতত আমেরিকার সঙ্গে ক্রিকেটের যোগসূত্র বোঝাতেই তথ্যটা কাজে লাগুক। শুধুই স্কোরিং সাইট থেকে ক্রিকইনফোর পরিপূর্ণ এক ক্রিকেট ম্যাগাজিন হয়ে ওঠার গল্পটাও নাহয় পরে কোনো একসময়।
যা বলার জন্য এই ভূমিকা, তা হলো, ক্রিকইনফো লাইভে ম্যাচের ফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার একটা বিভাগ আছে। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে রান তাড়া করতে নামা যুক্তরাষ্ট্রের ইনিংসের ৮ ওভার শেষে সেই ‘ক্রিকইনফো ফোরকাস্ট’ কী বলছিল, জানেন? যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের সম্ভাবনা মাত্র ৫.৬৫ শতাংশ। এখন অস্বীকার করলে হবে না, আপনিও তখন এমনই ভাবছিলেন। ৮ ওভারে স্কোর ৪৮, বাকি ১২ ওভারে প্রয়োজন ১৪৭ রান—এই ম্যাচে ব্যাটিং-দলের জয়ের সম্ভাবনা ৫-৬ শতাংশের বেশি কীভাবে হয়? এই ম্যাচ তো কানাডাই জিতছে। সেই কানাডা, যারা এই কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৪-০–তে সিরিজ হেরেছে।
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা আপনি এরই মধ্যে জেনে গেছেন বলেই অনুমান করি। সমীকরণটাকে বল আর রানের হিসাবে নিলে যুক্তরাষ্ট্রের এই জয় কতটা অভাবনীয় ছিল, তা বুঝতে সুবিধা হবে। ৭২ বলে ১৪৭ রান। ওভারপ্রতি হিসাব করলে ১২.২৫ রান।
৭২ বলে ১৪৭ লাগত। পরের ৫৮ বলেই ১৪৯ করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। আরও নির্দিষ্ট করে বললে তা করে ফেলেছেন অ্যারন জোন্স ও আন্দ্রিস গুস। দুজনের ১৩১ রানের জুটিতে রানরেট ১৪.২৯। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আর কোনো শতরানের জুটিতে এত দ্রুত রান ওঠার রেকর্ড নেই।
১৪ বল ও ৭ উইকেট হাতে রেখে এই জয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক মোনাঙ্ক প্যাটেল যে ভারত ও পাকিস্তানকেও হুমকি দেওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কদিন আগে সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাঁর। কথায় কথায় বলেছিলাম, গ্রুপে ভারত ও পাকিস্তান—সুপার এইটে ওঠার কথা ভাবাটা তো একটু বাড়াবাড়িই। মোনাঙ্ক প্যাটেল নিষ্কম্প কণ্ঠে বলে দিয়েছেন, কেন ভাবব না? জানি, সে জন্য আমাদের তিনটি ম্যাচ জিততে হবে।
আত্মবিশ্বাস বলতে পারেন। আবার অন্য চোখে দেখলে অকারণ আত্মম্ভরিতাও। ভারত-পাকিস্তান আর কানাডা যে এক নয়, এটা কে না জানে! মোনাঙ্ক প্যাটেলেরও নিশ্চয়ই তা অজানা নয়। কিন্তু ওই যে বড় স্বপ্ন দেখার সাহস, এটা কার না মন ছুঁয়ে যাবে বলুন!
এই ম্যাচের আগে অ্যারন জোন্সের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ছিল ১০৪। হাফ সেঞ্চুরি ছিল মাত্র ১টি। গত বছর মেজর লিগ ক্রিকেটে সিয়াটল ওকরাস দলে নিয়েও তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে কিছুদিন পর। আগামী মৌসুমের জন্য প্রথম ড্রাফটে কোনো দল জোন্সকে নেয়নি। এ মাসেই দ্বিতীয় ড্রাফট। ২৩৫ স্ট্রাইক রেটের এই ইনিংসের পর অ্যারন জোন্সকে নিয়ে এখন কাড়াকাড়ি পড়ে না গেলে সেটিই হবে আশ্চর্যের।
মাত্র ২২ বলে ফিফটি করেছেন। ৪০ বলে অপরাজিত ৯৪। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অভিষেক ইনিংসে এর চেয়ে বেশি রান আছে শুধুই একজনের। এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার দিক থেকেও শুধু ওই একজনই এগিয়ে অ্যারন জোন্সের চেয়ে। নাম বললেই আপনি চিনবেন। ক্রিস গেইল।
গেইল একবার ১১টি ছক্কা মেরেছেন। আরেকবার ১০টি। অ্যারন জোন্সও ১০টি ছক্কা মেরেছেন এদিন। যেখানে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এর আগের ২৪ ইনিংস মিলিয়ে তাঁর ছক্কা ছিল ১৩টি। গেইলের শরীর-স্বাস্থ্য দেখলেই তাঁর ছক্কা মারার রহস্য কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়ে যেত। অ্যারন জোন্সের ঘটনা পুরো উল্টো। নিউইয়র্কের কুইন্সের জন্মের পর বার্বাডোজে বেড়ে ওঠা ব্যাটসম্যানকে দেখে বিশ্বাস করা কঠিন, এই শরীরে এত শক্তি! সংবাদ সম্মেলনের চেয়ারে বসে ঠিকমতো মাইকের নাগালই পাচ্ছেন না!
অ্যারন জোন্স প্রতিদিন এমন খেলতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্রও এমন অনায়াস রান তাড়া করতে পারবে না সব সময়। কিন্তু ক্রিকেটে বহুল প্রচলিত ‘ইনটেন্ট’ বলে যে কথাটা আছে, সেটি নেই বলে কেউ অভিযুক্ত করতে পারবেন না জোন্স বা যুক্তরাষ্ট্রকে।
এখানেই বাংলাদেশ দলকে নিয়ে দুঃখটা বেড়ে যায়। ক্রিকেটে কখনো সবকিছু ঠিকঠাক হবে, কখনো হবে না। কিন্তু ব্যাটিংয়ে ইতিবাচক চিন্তার প্রতিফলন তো থাকবে। কিছুদিন আগে দেওয়া অ্যারন জোন্সের একটা সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র কেমন ক্রিকেট খেলতে চায়, প্রশ্নে যেখানে তিনি তাঁর দলের কাঙ্ক্ষিত খেলার ধরনটা নিয়ে বলছেন ‘ফিয়ারলেস ক্রিকেট’, ‘পজিটিভ ক্রিকেট’, ‘স্মার্ট ক্রিকেট’। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মুখে এই কথাটাই তো সেভাবে শোনা যায় না। কখনো শোনা গেলেও মাঠে খেলা দেখে বোঝা যায়, ওটা ছিল কথার কথা। আত্মবিশ্বাসের অভাব, প্রত্যাশার চাপে কুঁকড়ে যাওয়া, নাকি দক্ষতাতেই সমস্যা?
অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র পেরেছে বলে এত কথা হচ্ছে। যারা পারেনি, সেই কানাডাকেও দেখুন। প্রথম বলেই অ্যারন জনসন চার মেরে দিলেন। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেই এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত মাত্র দুজন ব্যাটসম্যান দেড় শর বেশি স্ট্রাইক রেট ও ৫০-এর বেশি গড়ে সাত শর বেশি রান করেছেন। একজন ভারতের সূর্যকুমার যাদব, অন্যজন এই অ্যারন জনসন। বোলিং ভালো ছিল না, বলবেন তো? তা ওই ‘দুর্বল’ বোলিংয়ের বিপক্ষে অন্যরাও তো খেলেছেন। তাঁরা পারেননি কেন?
শুধু ইনিংসের প্রথম বলে চার মারার কারণেই বলা হচ্ছে না, কানাডার ব্যাটসম্যানরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তো আক্রমণাত্মকতার সুরে বাঁধা ব্যাটিংই করে গেলেন। বাংলাদেশ কেন তা পারে না? আবারও সেই প্রশ্নটা আসে—ব্যর্থতার ভয়, সমালোচনার ভয়, নাকি দক্ষতারই অভাব?