আউট হয়ে ফিরছেন তাওহিদ হৃদয়। ৭৪ রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে
আউট হয়ে ফিরছেন তাওহিদ হৃদয়। ৭৪ রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে

ভারত থেকে উৎপল শুভ্র

৩৫০–৩৬০ রান করলেও কি জিতত বাংলাদেশ

একটা জয়ে শেষ হলে অবশ্যই আরও ভালো হতো। তিনের নামতাটা তাহলে অন্তত ঠিক থাকত। তিনের নামতা মানে কী, বুঝেছেন তো? একরকম নিয়ম হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের বিশ্বকাপ।

সেই ২০০৭ সাল থেকে টানা চারটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এই তিনের বৃত্তে ঘুরপাক। চারটি বিশ্বকাপেই তিনটি করে জয়। সেই বৃত্ত ভাঙার মিশন ছিল এবার। তাতে তো সফলই। তবে অর্থে, তিন জয়ের বদলে এবার জয় দুটি।

একটা জয়ে শেষ হলে অবশ্যই ভালো হতো। শেষটা ভালো করার তৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরতে পারত বাংলাদেশ দল। কিন্তু তা কি আসলে হওয়ার কথা ছিল! ক্রিকেট খেলায় অভাবনীয় অনেক কিছুই ঘটে। তবে তা প্রতিদিন ঘটে না বলেই তো সেটি অভাবনীয়। এই বিশ্বকাপে আগের আট ম্যাচ মনে রাখলে আপনারও এটা ভাবার কথা নয় যে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে।

আচ্ছা, ম্যাচের আগে না হয় এটা ভাবার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ৩০০ ছাড়ানো স্কোর করে ফেলার পর? তখন তো কেউ ভাবতেই পারতেন, ১৮ বছর আগের কার্ডিফ নেমে আসতেও পারে পুনের বুকে। সম্ভাবনা কি ছিল? মোহাম্মদ আশরাফুল একটুও আশাবাদী ছিলেন না। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র জয়ের নায়কের কাছে ৩০৬ রানও কোনো ব্যাপার মনে না হওয়ার কারণ একটাই। পুনের উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকেও যেখানে নির্বিষ বলে মনে হয়েছে। স্পিননির্ভর বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ সেখানে কী করবে? ম্যাচটা তাই এমনভাবে শেষ হলো, যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, বাংলাদেশ ৩৫০-৩৬০ করলেও কিছু আসত-যেত না।

মিচেল মার্শ ও স্টিভ স্মিথ কোনো সুযোগই দেননি বাংলাদেশকে

এই ব্যাটিং-স্বর্গে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে ৩০৬ রান করতে না দেওয়ার মতো বোলিং আক্রমণ এই বিশ্বকাপে একটা দলেরই শুধু আছে বলে মনে করেন আশরাফুল। সেই দলটির নাম ভারত।

জয়-পরাজয়ের বাইরেও এই ম্যাচে অন্য একটা হিসাব ছিল। ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে প্রথম আটে থাকার হিসাব। বাংলাদেশের ইনিংসের পরই অবশ্য সেটির মোটামুটি মীমাংসা হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া সর্বোচ্চ ২২.৪ ওভারের মধ্যে ৩০৬ রান টপকে গেলে নেট রান রেটে বাংলাদেশ নেমে যেত শ্রীলঙ্কার নিচে। উইকেট যতই ভালো হোক, বোলিং যতই খারাপ হোক...এটা কি আর হওয়ার নাকি! তা ছাড়া এমন তো নয় যে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার নিচে নামিয়ে দেওয়ার কোনো লক্ষ্য ছিল অস্ট্রেলিয়ার।
অস্ট্রেলিয়ার দিক থেকেও একটা হিসাব ছিল। আসলেই কি ছিল? ম্যাচের আগের দিন দলের স্পিন বোলিং কোচ ড্যানিয়েল ভেট্টোরি এই ম্যাচ থেকে অস্ট্রেলিয়ার কী পাওয়ার আছে, বলতে গিয়ে হয়তো রসিকতাই করেছিলেন। ইডেন গার্ডেনের হোম ড্রেসিংরুমটা বেশি ভালো। দ্বিতীয় হয়ে সেমিফাইনালে উঠে অস্ট্রেলিয়া সেই ড্রেসিংরুমে থাকতে চায়। এই লক্ষ্য পূরণ করতে অস্ট্রেলিয়াকে কী করতে হতো, জানেন? ১৭.২ ওভারে টপকে যেতে হতো বাংলাদেশের রান।

ম্যাচ শেষে ১৭৭ রানে অপরাজিত মিচেল মার্শের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন মেহেদী হাসান

দ্বিতীয় হয়ে সেমিফাইনাল, না তৃতীয় হয়ে—এতে আসলে কিছু আসে–যায় না। ৮ নম্বরে থাকতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার লড়াই নিয়েও অস্ট্রেলিয়ার কোনো আগ্রহ থাকার কারণ নেই। এই দুটি সমীকরণ তাই অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে আলোচিতই হয়নি। টানা জয়ের ধারাটাকে সাত ম্যাচে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল যেখানে একমাত্র চাওয়া। বাংলাদেশের ইনিংস শেষে সেই চাওয়াও অবশ্য খুব সামান্য হয়ে থাকেনি। এই ম্যাচ জিততে আগের ম্যাচে গড়া রেকর্ডই যে এখানে ভাঙতে হয়।

চার দিন আগে মুম্বাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডটা একটু আড়ালে চলে গেছে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অবিশ্বাস্য ওই ডাবল সেঞ্চুরিতে। এখানে চ্যালেঞ্জটা আরও ১৫ রান বেশি এবং ম্যাক্সওয়েল নেই। ম্যাচটার বাড়তি গুরুত্ব থাকলে নিশ্চয়ই খেলে ফেলতেন। নিয়ম রক্ষার ম্যাচে বিশ্রাম দিয়ে ১৬ নভেম্বরের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আরও তরতাজা ম্যাক্সওয়েলকে পাওয়ার সুযোগটা কেন নেবে না অস্ট্রেলিয়া!

আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিশতক রানের ইনিংসে ১০ ছক্কা মেরেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। আজ বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেননি তিনি

এই ম্যাচের আগে গত চার বছরে ৩০০–এর বেশি রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়ার জয় মাত্র একটাই। ঘটনাচক্রে ২০২০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচেও সেঞ্চুরি ছিল গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের। এদিন ম্যাক্সওয়েল না থাকুন, মিচেল মার্শ তো ছিলেন। সেদিন মুম্বাইয়ে ম্যাক্সওয়েলের অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরিতে ছক্কা ছিল ১০টি। ছক্কায় তাঁকে প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন মার্শ। ছক্কা মারলেন তো মাত্র একটিই কম। বাংলাদেশ আরেকটু বেশি রান করলে ডাবল সেঞ্চুরিটাও হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত ১৭৭ রানে অপরাজিত। বোলিংয়ে ৪ ওভারে ৪৮ রান দিয়ে ফেলার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ব্যাটিং করতে নামার সময় ৫০ মাইনাস ছিলাম। কিছু তাই করতেই হতো।’

বাংলাদেশের ইনিংসটা খুব অদ্ভুত। সব ব্যাটসম্যানই স্বচ্ছন্দে শুরু করছেন। রানও করছেন। বাংলাদেশের প্রথম সাত ব্যাটসম্যানেরই ২০-এর বেশি রান। তবে তাওহিদ হৃদয় ছাড়া আর কারও অর্ধশতক নেই। দারুণ খেলতে থাকা নাজমুল আর মাহমুদউল্লাহ রানআউট হয়ে না গেলে হয়তো এমন হয় না। বাংলাদেশের স্কোরটাও আরও অনেক বড় হয়।

রানআউট হন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল। দুটি রানআউটে পুড়েছে বাংলাদেশের ইনিংস

যা হয়নি, তা নিয়ে কথা বলে তো আর লাভ নেই। যা হয়েছে, সেটাই সত্যি। বাংলাদেশ দুই জয়ে শেষ করেছে বিশ্বকাপ। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কোয়ালিফাই করার পরিবর্তিত লক্ষ্য পূরণ হলো কি না, তা জানতে অবশ্য আজকের দিনটা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যেটির পূর্বশর্ত নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ভারতের জয়।

বেঙ্গালুরুতে আগামীকাল যেন বৃষ্টি না নামে, সেই প্রার্থনাই করুন না হয়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩০৬/৮
অস্ট্রেলিয়া: ৪৪.৪ ওভারে ৩০৭/২
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে জয়ী