একসঙ্গে একটি টেস্টই খেলেছেন তিন মোহাম্মদ ভাই। ১৯৬৯ সালে সেই করাচি টেস্টের আগে মুশতাক, হানিফ ও সাদিক মোহাম্মদ
একসঙ্গে একটি টেস্টই খেলেছেন তিন মোহাম্মদ ভাই। ১৯৬৯ সালে সেই করাচি টেস্টের আগে মুশতাক, হানিফ ও সাদিক মোহাম্মদ

মোহাম্মদ ভাইদের জন্য ২৪ অক্টোবর কেন বিশেষ কিছু

ক্রিকেটে বিখ্যাত ভাইদের কথা বললে প্রথমেই কাদের কথা মনে পড়ে? তরুণ ক্রিকেটানুরাগীরা হয়তো ওয়াহ ব্রাদার্সের কথা বলবেন। আরেকটু পিছিয়ে যেতে বললে আসবে চ্যাপেল ব্রাদার্স। আর ক্রিকেট ইতিহাসের মনোযোগী পাঠক অবশ্যই মনে করিয়ে দেবেন, শুরুটা হয়েছিল তো টেস্ট ক্রিকেটের সেই শুরুর দিকেই। গ্রেস ব্রাদারদের দিয়ে।

ডব্লু জি গ্রেস ক্রিকেটের অমর এক চরিত্র। রান আর উইকেটেই প্রাতঃস্মরণীয়, আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের ভিতও তাঁরই গড়ে দেওয়া বলে ক্রিকেটে দাড়িওয়ালা বুড়োর জন্য আলাদা একটা জায়গা বরাদ্দ রাখতে হয়। ডব্লু জির দুই ভাই–ও টেস্ট খেলেছেন। একটিতে তিন ভাই একসঙ্গেও খেলেছেন।

স্টিভ ও মার্ক ওয়াহর মিলিত কীর্তি এক কথায় বিস্ময়কর। ইয়ান চ্যাপেল ও গ্রেগ চ্যাপেলও খুব একটা পিছিয়ে নন। তবে ভাইয়ের সংখ্যাটা বাড়িয়ে নিলে পাকিস্তানের মোহাম্মদ ব্রাদার্সের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। চার ভাইয়ের টেস্ট ক্রিকেট খেলার অবিশ্বাস্য কীর্তি তো শুধু তাঁদেরই।

সংখ্যাটা ’পাঁচ’–ও হয়ে যেতে পারত, হয়নি রাইস মোহাম্মদ অল্পের জন্য টেস্ট খেলতে না পারায়। অল্পের জন্য কথাটার ব্যাখ্যা দিতে এটা উল্লেখ করলেই চলছে, এক টেস্টে রাইস ছিলেন পাকিস্তানের দ্বাদশ খেলোয়াড়।

ওয়াজির মোহাম্মদ, হানিফ মোহাম্মদ, মুশতাক মোহাম্মদ ও সাদিক মোহাম্মদ মিলে টেস্ট খেলেছেন মোট ১৭৩টি। হানিফ মোহাম্মদের ছেলে শোয়েব মোহাম্মদের ৪৫ টেস্টও যোগ করলে মোহাম্মদ পরিবারে মোট টেস্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৮। এটিকে যদি রেকর্ড বলেন, সেই রেকর্ডকে অবিনশ্বর মেনে নেওয়াই ভালো। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন বর্ণিল পরিবার আর একটাও নেই।

পাঁচ মোহাম্মদ ভাই—হানিফ, রাইস, ওয়াজির, মুশতাক ও সাদিক মোহাম্মদ। এঁদের মধ্যে শুধু রাইস মোহাম্মদেরই টেস্ট খেলা হয়নি

মোহাম্মদ ভাইদের নিয়ে চাইলে হাজার হাজার শব্দ লেখা যায়। এই লেখার বিষয় ঠিক তা নয়। বিষয় মোহাম্মদ ভাইদের দুটি কীর্তি। কাকতালীয়ভাবে যে দুটিই আবার সাত বছর আগে–পরের ২৪ অক্টোবরে।

প্রথমটি ৫৫ বছর আগে আজকের দিনে, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৪ অক্টোবর। করাচিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের ইনিংস ওপেন করতে নামলেন দুই ভাই হানিফ ও সাদিক মোহাম্মদ। তাঁদের আরেক ভাই মুশতাক মোহাম্মদও চারে ব্যাটিং করেছেন সেই টেস্টে। হানিফের সেটি শেষ টেস্ট, পাকিস্তানের প্রথম ৫৭ টেস্টের মাত্র দুটিতেই যিনি খেলেননি।

হানিফ মোহাম্মদ ও সাদিক মোহাম্মদের একসঙ্গে ইনিংস শুরু করা টেস্ট ক্রিকেটে দুই ভাইয়ের ব্যাটিং ওপেন করার মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা। প্রথমটি সেই ১৮৮০ সালে, যখন ডব্লু জি গ্রেস ছোট ভাই এডওয়ার্ড গ্রেসকে নিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ওপেন করেছিলেন।

মোহাম্মদ ভাইদের মধ্যে একমাত্র বাঁহাতি সাদিকের আবার সেটি টেস্ট অভিষেক। সাদিক মোহাম্মদের বাঁহাতি হয়ে যাওয়া নিয়েও একটা গল্প আছে। জন্মগতভাবে বাঁহাতি ছিলেন না। বড় ভাইদের একজন, সম্ভবত ওয়াজির মোহাম্মদই তাঁকে বলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হয়ে যেতে। কারণ তাতে পাকিস্তান দলে সুযোগ পেতে সুবিধা হবে। কারণটা অনুমান করাই যায়। পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন আপে তখন সম্ভবত বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন না।

হানিফ মোহাম্মদ ও সাদিক মোহাম্মদের একসঙ্গে ইনিংস শুরু করা টেস্ট ক্রিকেটে দুই ভাইয়ের ব্যাটিং ওপেন করার মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা। প্রথমটি সেই ১৮৮০ সালে, যখন ডব্লু জি গ্রেস ছোট ভাই এডওয়ার্ড গ্রেসকে নিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ওপেন করেছিলেন।অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওভালের সেই টেস্টে দুই ভাইয়ের ওপেনিং জুটিতে ৯১ রান আসার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে কেন তাঁরা ৬ আর ৭ নম্বরে ব্যাটিং করেছিলেন, তা একটা রহস্য বটে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা, উইকেট ঢেকে না রাখার সেই সময়ে বৃষ্টির পর ব্যাটিংয়ের জন্য রীতিমতো নরক হয়ে উঠত উইকেট। ‘স্টিকি উইকেটে’ ভালো ব্যাটসম্যানদের সুরক্ষা দিতে অনেক সময় তাঁদের নিচে নামিয়ে আনা হতো। যাতে রোদে পুড়ে উইকেট একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে তাঁরা ব্যাটিং করতে নামতে পারেন। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসেও ওপেনারদের একজনের নামের শেষে ‘গ্রেস’ ছিল। গ্রেস ভাইদের সবচেয়ে ছোট ফ্রেড গ্রেসের ওই একটিই টেস্ট।

আবার মোহাম্মদ ভাইয়ে ফেরা যাক। দুই ভাইয়ের ওপেন করার দিনে সাদিক মোহাম্মদ অভিষেক ইনিংসেই হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে ওপেনিং জুটিও দুই ইনিংসেই সফল। প্রথম ইনিংসে ৫৫ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে আরও ভালো, ৭৫।

একই টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন দুই মোহাম্মদ ভাই—সাদিক ও মুশতাক

সাত বছর পর, ১৯৭৬ সালের ২৪ অক্টোবর মোহাম্মদ ভাইদের দ্বিতীয় যে কীর্তি, সাদিক মোহাম্মদ সেখানেও আছেন। সঙ্গী মুশতাক মোহাম্মদ। এখানেও প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে দুই ভাই-ই সেঞ্চুরি করলেন। ব্যাটিংয়ের সময় অবশ্য উইকেটে দুজনের দেখা হয়নি। ১০৩ রান করার পর চোট পেয়ে অবসর নিতে বাধ্য হন সাদিক। মাজিদ খানের সঙ্গে তাঁর উদ্বোধনী জুটিতে ততক্ষণে ১৩৬ রান হয়ে গেছে। মুশতাক মোহাম্মদ নেমেছিলেন ৫ নম্বরে। ভাইয়ের মতো তাঁর ইনিংসেরও স্বাভাবিক সমাপ্তি হয়নি। তাঁকে ফিরতে হয় রান আউট হয়ে।

হানিফ–সাদিক যেমন দুই ভাইয়ের ওপেন করার দ্বিতীয় কীর্তি গড়েছিলেন, একই টেস্টে দুই ভাইয়ের সেঞ্চুরি করার কীর্তিতেও মুশতাক–সাদিক দ্বিতীয়। এর আগেই তা করে রেখেছেন ইয়ান চ্যাপেল ও গ্রেগ চ্যাপেল। সংখ্যাটা অবশ্য এখন পাঁচ হয়ে গেছে। চ্যাপেল ও মোহাম্মদ ব্রাদার্সের পর জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ও গ্রান্ট ফ্লাওয়ার একই টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন, একই বছর (১৯৯৫) স্টিভ ও মার্ক ওয়াহ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শন ও মিচেল মার্শ।

এক টেস্টে দুই ভাইয়ের সেঞ্চুরি করার কীর্তিতে দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার জয়জয়কার। পাঁচ জোড়া ভাইয়ের তিন জোড়াই তো অস্ট্রেলিয়ার। তবে মোহাম্মদ ভাইয়েরা বলতেই পারেন, আমাদের সঙ্গে তুলনা করতে আসবেন না। আমরা তো একসঙ্গে ওপেনও করেছি। দুই ভাইয়ের ইনিংস ওপেন করা আর একই টেস্টে দুই ভাইয়ের সেঞ্চুরির কীর্তি আর কোন ভাইদের আছে?