একটু দম নেওয়ার সময়ও নেই। একটি ম্যাচ খেলেই পরের ম্যাচের ছক কষতে হচ্ছে। সুপার এইটে বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থা এখন এমনই। গত বৃহস্পতিবার বার্বাডোজে আফগানিস্তানকে ৪৭ রানে হারিয়ে আজ আবার মাঠে নামতে হচ্ছে ভারতকে। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ।
নাজমুল হোসেনের দলেরও দম ফেলার ফুরসত নেই। অ্যান্টিগার স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে সুপার এইটে গতকাল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডিএলএস পদ্ধতিতে ২৮ রানে হেরেছে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচ শেষ হওয়ার ৩৪ ঘণ্টার মধ্যে আবারও নামতে হচ্ছে একই মাঠে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ৩০ মিনিটে।
চলতি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত এখনো ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে খেলেনি। অতীতে পেসবান্ধব থাকলেও টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই মাঠের উইকেটের চরিত্র তো মোটামুটি সবারই জানা হয়ে গেছে। ভারতের ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে উইকেট স্পিনারদের কিছুটা সহায়তা করবে।’ অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের পর বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুলও উইকেট ভালো বললেও একটু মন্থর সেটাও উল্লেখ করেছিলেন। অর্থাৎ, বল একটু থেমে আসবে এবং তাতে স্পিনারদের বাঁক পাওয়াই স্বাভাবিক।
তাহলে বোলিংয়ে দুই দলের মূল লড়াইটা কি স্পিনারদের মধ্যে হতে চলেছে? সেই সম্ভাবনাই বেশি।
নিউইয়র্কের কন্ডিশনে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচেও চার পেসার খেলিয়েছে ভারত। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাওয়ার পর বার্বাডোজে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই বিশেষজ্ঞ পেসারের সঙ্গে তিন বিশেষজ্ঞ স্পিনার খেলিয়েছে ভারত—রবীন্দ্র জাদেজা, কুলদীপ যাদব ও অক্ষর প্যাটেল। তিন স্পিনারই উইকেট পেয়েছেন। কুলদীপ পেয়েছেন ২ উইকেট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে এ পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। গ্রুপপর্বে দুটি ম্যাচ খেলেছে সেন্ট ভিনসেন্টে। সেখানকার উইকেট ব্যাটিং উপযোগী ছিল না। ভারতের বিপক্ষে আজকের ম্যাচটি যেহেতু ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে, তাই এই মাঠে বাংলাদেশের সর্বশেষ ম্যাচে স্পিনারদের পারফরম্যান্সটা দেখে নেওয়া যায়।
গতকালের বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ১১.২ ওভার বোলিংয়ের সুযোগ পান বাংলাদেশের বোলাররা। অধিনায়ক নাজমুল দুই স্পিনার মেহেদী হাসান ও রিশাদ হোসেনকে দিয়ে মোট ৭ ওভার বোলিং করিয়েছেন। মেহেদী উইকেট না পেলেও বেশ আঁটসাঁট বোলিং করেন, ৪ ওভারে দেন ২২ রান। বাঁক না পেলেও উইকেট টু উইকেট বোলিং করেছিলেন। বাঁক মেহেদীর শক্তির জায়গা নয়, গতির বৈচিত্র্য এবং রান আটকে রাখার বোলিংটা ভালোই পারেন তিনি। রিশাদ ৩ ওভারে ২৩ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। সাকিব আল হাসানকে বোলিংয়ে আনেননি নাজমুল। তবে এবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বোলিংয়ে ধারাবাহিকভাবেই ভালো করছেন লেগ স্পিনার রিশাদ। ৫ ম্যাচে ১৮ ওভার বল করে ৬.৯৪ ইকোনমি রেটে নিয়েছেন ৯ উইকেট। ভারতের ব্যাটসম্যান বনাম রিশাদের লড়াইয়ে দিকে তাই তাকিয়ে থাকবেন অনেকেই।
ম্যান টু ম্যান বিবেচনা করলে ভারতের স্পিনাররাই বেশি অভিজ্ঞ। এবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের স্পিনারদের পারফরম্যান্সে একবার তাকানো যায়। রবীন্দ্র জাদেজা তিন ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ১ উইকেট। এক ম্যাচ খেলা কুলদীপের পারফরম্যান্স আগেই বলা হয়েছে। অক্ষর প্যাটেল সবচেয়ে ধারাবাহিক। চার ম্যাচেই ১টি করে উইকেট নিয়েছেন। নিউইয়র্কের উইকেট পেসবান্ধব হলেও অক্ষরের বোলিং এমন উইকেটেও বেশ কার্যকর ছিল। একটু জোরের ওপর বল ড্রিফট করাতে পারেন। বাঁকও পান। রান আটকাতে এমন বোলিংই দরকার ভারতের।
দুই দলের স্পিন বৈচিত্র্যে যদি তাকানো যায়, পার্থক্য চোখে পড়ে। ভারতের দুজন বাঁহাতি স্পিনার এবং কুলদীপ বাঁহাতি চায়নাম্যান। বাংলাদেশ বরং বৈচিত্র্যে একটু এগিয়ে। ডানহাতি অফ স্পিনার একজন, বাঁহাতিও একজন এবং অন্যজন ডানহাতি লেগ স্পিনার। ভারত আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে যে একাদশ খেলিয়েছে, সেখানে প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের মধ্যে চারজন ডানহাতি এবং দুজন বাঁহাতি। ম্যাচ আপের ক্ষেত্রে ডানহাতিদের বিপক্ষে রিশাদ ও সাকিবকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিপজ্জনক বাঁহাতি ওপেনার ট্রাভিস হেডকে তুলে নেওয়া রিশাদও জায়গামতো বল করতে দক্ষ।
ম্যাচ আপের ক্ষেত্রে ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মার ঝামেলাটা বেশি। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে বাংলাদেশের একাদশে তাকালে দেখা যায়, প্রথম সাত ব্যাটসম্যানের মধ্যে তিনজন বাঁহাতি ও চারজন ডানহাতি। অর্থাৎ কখন কোন স্পিনারকে কোন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে আনতে হবে, সে বিষয়ে মাথা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রোহিতকে।
এবার একটি পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যায়। ভারতের স্পিনার অক্ষর বাংলাদেশের বিপক্ষে এ পর্যন্ত একটি টি–টোয়েন্টি খেলে ১ ওভার বোলিং করে উইকেটের দেখা পাননি। জাদেজা ৪ ম্যাচে ১৫ ওভার বোলিং করে নিয়েছেন ৩ উইকেট। কুলদীপ বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সংস্করণে এখনো খেলেননি। তাঁকে খেলার অভিজ্ঞতা নেই বলেই আজকের ম্যাচে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। এমনিতেই উইকেট স্পিনবান্ধব আর কুলদীপ মূলত উইকেটশিকারি। ফ্লাইট এবং বাঁকের মিশ্রণে তাঁর ভালো ডেলিভারিগুলোর জবাব থাকে না! একই ব্যাপার ঘটতে পারে রিশাদের ক্ষেত্রেও। ভারতের বিপক্ষে খেলা হয়নি তাঁর। ভিডিও বিশ্লেষণে যতই তাঁর বোলিংয়ের মর্মোদ্ধার করা হোক, ক্রিজে দাঁড়িয়ে খেলা এক ব্যাপার আর ভিডিও দেখে মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া অন্য ব্যাপার।
টি–টোয়েন্টিতে মেহেদীকেও ভারতের ব্যাটসম্যানদের খেলার অভিজ্ঞতা নেই। তবে ওয়ানডেতে একবার মুখোমুখি হলেও ৫০ রানে ২ উইকেট নিয়ে এ স্পিনারই সে ম্যাচে সফল ছিলেন। ভারতের বিপক্ষে স্পিনারদের মধ্যে সাকিবের অভিজ্ঞতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। টি–টোয়েন্টিতে ৭ ইনিংসে ২৫ ওভার বল করে ৬ উইকেট নিয়েছেন। ইকোনমি রেটও ভালো—৭.০০। সাকিবকে আজ নিশ্চয়ই আগেভাগে বল করাতে চাইবেন নাজমুল। ভারতের টপ অর্ডারের গলায় ফাঁস পরাতে নতুন বলে তাঁর অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প হয় না। তবে এই ভূমিকায় রিশাদকে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আরও একটি বিষয় নিশ্চয়ই মাথায় রাখবেন দুই দলের অধিনায়ক। ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়াম থেকে ক্যারিবিয়ান সাগর কাছেই। ডাচম্যান সৈকত থেকে অনতিদূরেই এই স্টেডিয়াম। স্বাভাবিকভাবেই বাতাস একটি বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে। বাতাসের অনুকূলে কিংবা প্রতিকূলে কোন স্পিনারকে কখন বোলিংয়ে আনতে হবে, সে বিষয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে দুই দলের অধিনায়ককেই।
স্টেডিয়ামের চারপাশের সীমানাও খুব লম্বা নয়। স্ট্রেটে সর্বোচ্চ ৬৩ মিটার এবং থার্ডম্যান ও ফাইন লেগে ৫৮ মিটার। তবে বাতাসের অনুকূলে স্টেডিয়ামের তূলনামুলক ছোট সীমানা ব্যাটসম্যানের লেগ সাইডে থাকলে তখন নিশ্চয়ই বলে ফ্লাইট দেওয়ার স্পিনারকে না এনে একটু জোরের ওপর বল করা স্পিনারকে আনবেন দুই দলের অধিনায়ক।
মাঠে কী ঘটে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।