বাংলাদেশের দুই ওপেনার মাহমুদুল হাসান ও জাকির হাসান মাত্রই ক্রিজে নেমেছেন। চকচকে কুকাবুরা বল হাতে নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়ক টিম সাউদিও বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে। এমন সময় তড়িঘড়ি করে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারের ছাদে এলেন টনি হেমিং। হাতে কফির মগ। সাউদির প্রথম ডেলিভারিতে বলের ওঠার মাত্রাটা দেখেই তাঁর মুখে তৃপ্তির হাসি।
পাশেই দাঁড়ানো সম্প্রচারকের ক্যামেরায় প্রথম বলটা দেখলেন আরও একবার। এরপর একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে রেলিংয়ে পা তুলে বসলেন আয়েশ করে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ভালো কিছু একটা তৈরির তৃপ্তিতে মনে মনে পুলকিত!
টনির পরিচয় দেওয়া হয়নি। ৫৭ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর বিসিবির সঙ্গে দুই বছরের চুক্তিতে কাজ করছেন গত বছরের জুলাই থেকে। অভিজ্ঞতা? সংক্ষেপে বললে, মাঠকর্মী থেকে শুরু করে পিচ কিউরেটর—‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’–এর অভিজ্ঞতায় ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০ বছর।
টনি কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, পার্থ ও তাসমানিয়ায়। ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল সারের মাঠ ওভালেও উইকেট বানিয়েছেন। উপমহাদেশে অভিজ্ঞতার ভান্ডারও বিশাল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইসিসি একাডেমি ও দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের প্রধান কিউরেটর ছিলেন। ওমান ক্রিকেট একাডেমিতেও কাজ করেছেন।
কিউরেটর প্রশিক্ষক ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের।
এ তো গেল শুধু ক্রিকেটের গল্প। টার্ফ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে টনি ফুটবলেও কাজ করেছেন। সৌদি আরবের কিং ফাহাদ স্টেডিয়ামের অ্যারেনা ম্যানেজার ছিলেন। গত বছর কাতার বিশ্বকাপের একটি স্টেডিয়ামে কাজ করেছেন পরামর্শক হিসেবে।
প্রশিক্ষক ছিলেন স্পেনের ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাতেও। এসব শুনে মনে হতে পারে ক্রিকেট ও ফুটবলই বুঝি টনি হেমিংয়ের জীবন। সেটা হয়তো চোখের সামনে দেখায় বলে। আসলে টনি হেমিংয়ের জীবন তো ঘাস, মাটি, পানি, আলো, বাতাস! ক্রিকেট ও ফুটবলে তাঁর কাজের সঙ্গে প্রকৃতির এসব উপাদান যে নিবিড়ভাবে জড়িত।
নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে টনি দুটি বইও লিখেছেন। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত মেলবোর্ন টেস্টের উইকেট নিয়ে লিখেছিলেন, ‘১৯৮৬ এমসিজি টেস্ট পিচ’। মধ্যপ্রাচ্যে টনির ১২ বছরের অভিজ্ঞতা জানতে পড়তে পারেন ‘এক্সট্রিম স্টেডিয়াম টার্ফ, মিডল ইস্ট’ বইটি।
বাংলাদেশে এসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তৃতীয় বই নিয়ে কাজ করছেন টনি। বাংলাদেশে তাঁর কাজ মূলত নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা স্টেডিয়াম নিয়ে। নির্বাচনী ব্যস্ততায় আপাতত সে কাজ এগোচ্ছে ঢিমেতালে। বিসিবি এ সময়ে তাঁকে অন্য ভেন্যুতে কাজে লাগাচ্ছে। সিলেটে টেস্ট ম্যাচের উইকেট টনি তৈরি করেছেন ১০ দিনে। এই কাজে নতুন বইয়ের জন্য কিছু নোটও টুকে রেখেছেন। সিলেটে কাজ শেষে টনি যাবেন বরিশালে।
সেখানেও একটি উইকেট তৈরি করবেন। মূল কাজ শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামে হলেও পুরো দেশের বিভিন্ন উইকেটে নিয়েই তাঁর কাজ করার ইচ্ছা। পর্দার আড়ালে কাজটা ঠিকঠাকমতো করতে পারলে বাংলাদেশ ক্রিকেট সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে—এটাই টনির চাওয়া।
টনি যখন দুবাই, শারজা, আবুধাবির মাঠের দায়িত্বে, তখন পাকিস্তান টেস্টে ১ নম্বর দল হয়ে ওঠে। মিসবাহ–উল–হক ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। মিসবাহ নাকি এখনো দেখা হলে টনিকে ধন্যবাদ দেন। মিডিয়া সেন্টারের ছাদ থেকে খেলায় চোখ রেখে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সেসব গল্পই করছিলেন টনি, ‘আপনি এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করতে পারেন না। একটা জায়গায় শ্রম দিয়েছেন, মেধা দিয়েছেন। সেখানে খেলে পাকিস্তান ১ নম্বর টেস্ট দল হলো। এটাই তো চাইবেন আপনি।’
কথাটা শেষ হতে না হতেই কাইল জেমিসনের বলে এলবিডব্লুর আবেদন। জাকিরের পায়ে বল লাগার সঙ্গে সঙ্গেই জেমিসনের চিৎকার, সঙ্গে যোগ দিল নিউজিল্যান্ড দলের বাকিরাও। কিন্তু টনি মাঠের বাইরে থেকেই আম্পায়ারের ভূমিকায় মাথা নাড়লেন, ‘না না, অনেক উঁচু।’ মাঠের আম্পায়ারও যেন টনিকে সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন। আউট না। কিউইদের তাতে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল না। সাউদি রিভিউ নিতে চাইলেন। টনি তাতে একটু হতাশ, ‘ভুল করল ভুল!’
ভুল রিভিউ নিয়ে নিউজিল্যান্ড দলও টনির কথাকেই সত্যি প্রমাণ করল। নিজের বানানো উইকেটে কোন জায়গায় থেকে বল কতটা উঠবে সেটা টনির জানা। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় সেসব বোঝাচ্ছিলেন। কোন বোলারের বল কোন লেংথ থেকে সাধারণত কত উঠতে পারে—এই আন্দাজের বাজিতে টনি নাকি বরাবরই জয়ী। অভিজ্ঞতা বলে কথা!
মেলবোর্নের মাঠকর্মী হিসেবে যখন টনির ক্যারিয়ার শুরু, ডেনিস লিলি তখন পেশাদার ক্রিকেটার। লিলির ক্যারিয়ারের শেষ বছরটা টনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে অ্যালান বোর্ডার যুগ থেকে ওয়াহ-ব্রাদার্স, শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, রিকি পটিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট—একের পর এক ‘নেম-ড্রপ’ করছিলেন টনি। এরপর মজা করে বললেন, ‘ওরা সবাই খেলার আগে আমার খোঁজ নিত। কারণ, উইকেট সম্পর্কে ধারণা নিতে হতো। খেলার পরে কেউ খোঁজ নিত না (হাসি)।’
ইংল্যান্ডে কাজ করার সুবাদে ম্যালকম মার্শাল, সিলভেস্টার ক্লার্ক, কার্টলি অ্যামব্রোসকে সামনে থেকে দেখেছেন। টনির ব্যক্তিগত পছন্দ ‘ম্যাকো’ (মার্শাল)। তবে তরুণ অ্যামব্রোসকে প্রথমবার দেখেই ভবিষ্যৎ তারকার তকমা দিয়েছিলেন।
কেন এমন মনে হয়েছিল, বেশ গর্ব নিয়ে সে গল্পটাই বলছিলেন। তখন জেমিসন তাঁর স্পেলের শেষ ওভারে। অ্যামব্রোসের গল্প শোনাতে গিয়ে জেমিসনের উচ্চতার সঙ্গে ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির মিল খুঁজে পেলেন টনি। জেমিসনের হালকা প্রশংসাও করলেন। কিন্তু মুহূর্তখানেক পরই যেন মস্ত ভুল হয়েছে এমন মুখভঙ্গি করে নিজেকে শুধরে নিলেন। অস্ট্রেলিয়ানদের মুখে কোনো নিউজিল্যান্ডারের প্রশংসা তো সাজে না!
অর্থাৎ সিলেটের উইকেটে বাংলাদেশ দল নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারলে সেই জয় কিন্তু টনিরও!