বৃষ্টিতে ১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট বন্ধ থাকার পর মাত্রই খেলা শুরু হয়েছে। আলো কম বলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে শুধু স্পিনার দিয়ে বল করাতে বললেন আম্পায়াররা। বৃষ্টি আসার আগেই ইনিংসে ৮০ ওভার হয়ে গেলেও তাই নতুন বল নেননি এইডেন মার্করাম। উইকেটে বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাঈম হাসান। কিন্তু খেলা হতে পারল মাত্র ৫ ওভার, বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে যোগ হলো ১৬ রান।
আরও কিছু সময় অপেক্ষার পর এবার দিনের খেলারই সমাপ্তি ঘোষণা করে দেন আম্পায়াররা। সকালে যেভাবে দিন শুরু হয়েছিল, বাংলাদেশের জন্য ৭ উইকেটে ২৮৩ রান করে ৮১ রানের লিড আর টেস্টটা চতুর্থ দিনে যাওয়াও তখন স্বস্তির মনে হচ্ছিল। সপ্তম উইকেটে মিরাজ আর জাকের আলীর ১৩৮ রানের রেকর্ড জুটি এবং এরপর ওই বৃষ্টির বাধাটা না এলে ততক্ষণে যে খেলাই শেষ হয়ে যেতে পারত!
তখনই কিছু সময়ের জন্য মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে আসা জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে বিসিবির নারী ক্রিকেটের প্রধান হাবিবুল বাশার মাঠের দিকে তাকিয়ে আফসোস করছিলেন, ‘সকালে যদি তিনটা উইকেট না পড়ে যেত…! আসলে এ রকম সকালগুলোয় সব সময়ই আমাদের ওপর দিয়ে ঝড় যায়।’
মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে হাবিবুলের কথাটা হতে পারে সবারই মনের কথা। দিনের প্রথম সেশনে ৫৩ রানের মধ্যে ৩ উইকেট না হারালে তৃতীয় দিনের শেষে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডের চেহারা নিশ্চয়ই আরও ভালো থাকত, এমনকি চোখও রাঙাতে পারত দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অমন নড়বড়ে শুরুর পরও যে তৃতীয় দিন শেষে এমন আফসোস করা যাচ্ছে, সেটার কৃতিত্ব মূলত মিরাজ আর জাকেরের ১৩৮ রানের জুটির। টেস্টে যেকোনো উইকেটেই এটি এখন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি। দুজনে মিলে ছাপিয়ে গেছেন ২০০৩ সালে চট্টগ্রামে হাবিবুল বাশার ও জাভেদ ওমরের করা ১৩১ রানের জুটিকে।
প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ২০২ রান লিড সামনে রেখে কাল দ্বিতীয় দিনে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নেমে ৫৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ওপেনার মাহমুদুল হাসান আর অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিমের সৌজন্যে এরপর আর উইকেট পড়েনি, দিন শেষ হয় ওই ৩ উইকেটেই ১০১ রান নিয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামাতে তখনো দরকার ছিল আরও ১০১ রান। কিন্তু আজ দিনের চতুর্থ ওভারে কাগিসো রাবাদার ধাক্কায় মাত্র এক বলের ব্যবধানে বিদায় নেন মাহমুদুল, মুশফিকুর দুজনই। রাবাদাকে স্ল্যাশ করতে গিয়ে প্রথম স্লিপে বেডিংহামের হাতে ক্যাচ মাহমুদুল (৪০)। ভেতরে আসা এক বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে স্টাম্প উড়ে যায় মুশফিকের (৩৩)।
১০৬ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশের জন্য ভরসা হতে পারেননি লিটন দাসও (৭)। বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজকে সামনের পায়ে ডিফেন্স করতে গিয়েছিলেন, বল বাঁক খেয়ে ব্যাট ছুঁয়ে চলে যায় কাইল ভেরেইনার হাতে। আম্পায়ার প্রথমে আউট দেননি, রিভিউ নিয়ে সফল হন প্রোটিয়া অধিনায়ক এইডেন মার্করাম।
দিনের শুরুর ওই বিপর্যয়ে ১১২ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশ তখন ইনিংস হারের শঙ্কায়। সে লজ্জা এড়াতে বাকি ৪ উইকেটে করতে হতো আরও ৯০ রান। উইকেটে থাকা মিরাজ ভরসা হতে পারেন, কিন্তু দুশ্চিন্তা তো অন্য জায়গায়। তাঁকে সঙ্গ দিতে পারবেন তো অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা জাকের আলী বা অন্য কেউ!
আস্থার প্রতিদান দিয়ে মিরাজকে সময়োপযোগী সঙ্গই দিয়েছেন জাকের। তাঁদের প্রতিরোধে আর কোনো উইকেট না হারিয়ে ২০১ রান নিয়ে মধ্যাহ্নবিরতিকে যায় বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকাকে আরেকবার ব্যাটিংয়ে নামাতে আর মাত্র ১ রানই দরকার ছিল তখন।
ফিফটি এসেছে দুজনের ব্যাট থেকেই। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২ রান করে আউট হয়ে গেলেও জাকের দ্বিতীয় ইনিংসেই পেয়ে গেছেন প্রথম টেস্ট ফিফটি। সেটাও দলের বিপদে ত্রাতা হয়ে। ১১১ বলে ৫৮ রানের ইনিংসে ৫০ পূর্ণ করেন ডেন পিটের বলে ফাইন লেগ দিয়ে চার মেরে। দলের দুঃসময়ে তাঁর কার্যকর ইনিংসটা শেষ হয়েছে মহারাজের বলে এলবিডব্লু হয়ে। রিভিউ নিয়েও আউট এড়াতে পারেননি জাকের।
তবে দিনের শেষ পর্যন্ত অন্য প্রান্তে ভরসা দিয়ে গেছেন মিরাজ। টেস্টে নবম ফিফটিটাকে ৮৭ রানে নিয়ে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির সুবাসও ছড়াচ্ছিল তাঁর ব্যাট। জাকেরকে সঙ্গে নিয়ে ৭ চার ও ১ ছক্কায় করা ফিফটিতে ইনিংস হারের শঙ্কা দূর করায় এই অলরাউন্ডারের ভূমিকাই অগ্রণী। জাকের ফিরে যাওয়ার পর নাঈমের সঙ্গেও হয়ে গেছে ৩৩ রানের জুটি।
পাকিস্তান সফরে দুই টেস্টেই দলের বিপদের সময় ফিফটি করলেও সর্বশেষ ভারত সফরে রান পাননি মিরাজ। কিন্তু বরাবরই জানবাজি রেখে খেলা এই ক্রিকেটারের রানে ফিরতে সময় লাগেনি। ১৭১ বলে ৮৭ রান করে তাঁর সামনে এখন টেস্টে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির হাতছানি।
নাঈম, তাইজুল, হাসানদের নিয়ে কাল সেটিও পাওয়া হয়ে গেলে চতুর্থ ইনিংসটা দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যও কঠিন হয়ে উঠবে নিশ্চিত। কারণ, মিরপুর টেস্টের বাকি দুই দিনে যতটুকু খেলা হওয়ার সম্ভাবনা, ঠিক ততটুকুই যে আছে বৃষ্টির শঙ্কাও!
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৪০.১ ওভারে ১০৬
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৮৮.৪ ওভারে ৩০৮
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৮৫ ওভারে ২৮৩/৭
(মিরাজ ৮৭*, জাকের ৫৮, মাহমুদুল ৪০, মুশফিক ৩৩, নাজমুল ২৩, নাঈম ১৬*; রাবাদা ৪/৩৫, মহারাজ ৩/১০৫)।
* তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ৮১ রানে এগিয়ে।