কানফাটানো ‘গণসংগীতে’ কলি একটাই—‘মিরাজ...মিরাজ...মিরাজ।’ তার মধ্যেই ভারতের পেসার দীপক চাহার ৪৬তম ওভারের শেষ বলটা করতে দৌড় শুরু করলেন। অফস্টাম্পের বাইরের বল, কাভারের ওপর দিয়ে মেরেই ছুটলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। সে ছোটা অপর প্রান্তে পৌঁছে জয়সূচক রানটা শেষ করেও থামল না। একটা ছোট ‘ইউ টার্ন’ নিয়ে এবার ছুট ড্রেসিংরুম থেকে ছুটে আসা সতীর্থদের আনন্দ স্রোতের দিকে। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাঝমাঠের কাছাকাছি সেই স্রোতে মিলেমিশে একাকার মিরাজ-মোস্তাফিজ।
মিরাজ’—একটা নাম নয় শুধু। একটা জয়ের গল্প। একজন মহানায়কের চরিত্র। অন্তত আজ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে তিনি ব্যাট হাতে যা করে দেখালেন, তাতে মিরাজকে জয়ের মহানায়ক তো বটেই, আরও কিছু বললেও বেশি বলা হবে না। ভারতের ১৮৬ রান যখন দূরে সরতে সরতে সরতে একটা পর্যায়ে ধরাছোঁয়ার প্রায় বাইরেই চলে যাচ্ছিল, তখন মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে শেষ উইকেটে ৫১ রানের জুটিতে অবিশ্বাস্য এক জয়ের গল্প লিখলেন মিরাজ। যে ম্যাচ ভারত নিশ্চিত জেতে, সেটাতেই কিনা বাংলাদেশ জয়ী ১ উইকেটে!
বল হাতে সাকিব আল হাসান ৫ উইকেট নিয়েছেন, ফিল্ডিংয়ে অধিনায়ক লিটন দাস নিয়েছেন দুঃসাহসিক এক ক্যাচ, ব্যাটিংয়েও লিটন-সাকিব ভিত গড়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসবের পরও ভারতের বিপক্ষে এই ম্যাচ বাংলাদেশই হারত যদি না মিরাজ ওভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেন।
সঙ্গে মোস্তাফিজ যেটা করলেন, সেটাও কি কম অবিশ্বাস্য! ১৩৬ রানে নবম উইকেট পড়ার পর অতি আশাবাদীও নিশ্চয়ই ভাবেননি দশ নম্বর ব্যাটসম্যান, ব্যাট হাতে আনাড়ি মোস্তাফিজকে নিয়েই বাকি পথটা পাড়ি দিয়ে ফেলবেন মিরাজ। মিরাজ পারলেন কারণ মোস্তাফিজও সময়ের দাবি মিটিয়ে তাঁর কাজটা করেছেন।
কখনো কখনো যেমন মৌনতাও হয় প্রতিবাদের ভাষা, ক্রিকেটে তেমনি অনেক সময় রান না করেও জয়ের কাব্য লেখা যায়। শেষ উইকেটে মোস্তাফিজের কাজই ছিল উইকেট বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মিরাজকে সংগত দিয়ে যাওয়া, যেন যখন প্রান্ত পাবেন, মিরাজ রান তোলার কাজটা করতে পারেন। ওভার হাতে ছিল যথেষ্ট। কাজেই মোস্তাফিজ ‘ডট’ বল দিয়ে গেলেও সেসবই হতে পারত জয়ের কাব্যের একেকটি জ্বলজ্বলে শব্দ।
মোস্তাফিজকে দর্শকেরা সেটি করতেই উৎসাহ দিয়ে গেলেন। মোস্তাফিজ ব্যাটিংয়ে আসা মানে রান নয়, ঠেকাও। কিন্তু মোস্তাফিজ যে একেবারেই খোলসে ঢুকে ছিলেন, তা নয়। মিরাজের সঙ্গে শেষ উইকেটে রান তাড়া করে জেতায় রেকর্ড ৫১ রানের জুটিতে ১১ বলে অপরাজিত ১০ রান করেছেন, সেখানে আবার চমকে দেওয়ার মতো দুটি বাউন্ডারি!
মোস্তাফিজের এমন নির্ভরতা অপর প্রান্তে মিরাজকেও নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসী করেছে। আর এমন খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তোলাটা তো তাঁর জন্য নতুনও নয়। মোস্তাফিজের সংগত, নিজের অভিজ্ঞতা এবং গ্যালারির দর্শকদের আকাশ ফাটানো সমর্থনে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন মিরাজ।
নামের পাশে দুই ছক্কা আর চার বাউন্ডারিতে ৩৯ বলে অপরাজিত ৩৮ রান। কিন্তু সেটা কি মিরাজের কৃতিত্বটা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারছে? পারছে না।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পর গত দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের মানুষ ‘আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা’, ‘ব্রাজিল ব্রাজিল’ স্লোগান শুনে এবং দিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ মিরাজ সুযোগ করে দিলেন তার দশগুণ উল্লাসে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে গলা ফাটানোর। মিরপুরের গ্যালারিতে সেই উল্লাসের শেষটা যখন হয় ধরে আসা গলায়, আনন্দাশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি... ঠোঁটের আগায় অবচেতনে চলে আসে... অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য মিরাজ!