তৃতীয় দিন শেষেশ্রীলঙ্কা: ২৮০ ও ৪১৮বাংলাদেশ: ১৮৮ ও ৪৭/৫
জীবনে সাহস না থাকলে আর কী! অসম্ভবকে সম্ভব মনে করার সাহস। কোনো কিছু আগে কখনো হয়নি বলেই কখনোই কেন তা হবে না—এ প্রশ্ন করার সাহস। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিতে অগম্য, এমন দুঃসাহসী কিছু করে ফেলার সাহস।
প্রমাণ চান? কেন, আজ তৃতীয় দিন বিকেলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দেখেননি! আহা, আপনারা শুধু নেতিবাচক দিকটাই দেখেন। অফ স্টাম্পের এক মাইল বাইরের বলে নাজমুলের চালিয়ে দেওয়া দেখে কোথায় তাঁর ইতিবাচক মানসিকতাকে হাততালি দেবেন, তা না, উল্টো সমালোচনা! প্রথম বলেই লিটন যে ওভাবে বীর বিক্রমে বেরিয়ে গিয়ে বলটাকে স্টেডিয়ামের পাশের চা–বাগানে উড়িয়ে দিতে চাইলেন—সেই সাহসের প্রশংসা না করে সেটিকে কিনা বলছেন ‘পাগলামি’!
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করার সময় সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো ফল বলে ধরে নিয়েছেন, বৃষ্টির একটু দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে টেস্টটা ড্র করে ফেলা। জয়ের কথা ভাবারই সাহস পাননি। কারণ, সে জন্য সিলেট শহর থেকে দৃশ্যমান মেঘালয়ের যে পাহাড়, উঠতে হবে তার চেয়েও উঁচুতে। করতে হবে ৫১১ রান। টেস্ট ইতিহাসেই কখনো যা করতে পারেনি কোনো দল। রেকর্ডটা এর চেয়ে ৯৩ রান কম। তাতে কী! রেকর্ড গড়াই হয় ভাঙার জন্য—এই আপ্তবাক্য কি কখনো শোনেননি!
কোকাবুরা বল ১৯-২০ ওভার পুরোনো হয়ে যাওয়া মানে বোলারদের জারিজুরি অনেকটাই শেষ। পাশার দান উল্টে গিয়ে এরপর শুরু ব্যাটসম্যানদের সময়। প্রথম ২০ ওভার তাই বোলারদের চোখরাঙানি মেনে নিয়ে নিজের সময় আসার জন্য অপেক্ষা করার নিয়ম। সাহসের কথা বলছিলাম, এখানেও দেখুন না, এই নিয়মকে একটুও পাত্তা দিয়েছেন নাকি নাজমুল-লিটন! এই সাহসের প্রশংসা করবেন না? হাততালি দিন ভাই, হাততালি দিন।
লেখাটা কেমন কেমন লাগতেই পারে। ফ্লাডলাইট জ্বলে ওঠা আজকের পড়ন্ত বিকেলটাই যে কেমন কেমন! স্বাভাবিক ক্রিকেটীয় বিচারবুদ্ধি যেখানে অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ব্যাখ্যাতীত কোনো কিছু দেখার পর লেখায় সেটির ছাপ পড়াটাই কি স্বাভাবিক নয়!
নাজমুল আর লিটনের নামটাই বারবার কেন আসছে, তা কি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন? খেলা দেখে থাকলে তার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তামিম-সাকিব-মুশফিকবিহীন বাংলাদেশের এই ব্যাটিং লাইনআপ স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে অনভিজ্ঞ। ৫০-এর বেশি টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা বলতে শুধু এক মুমিনুল হক। দায়িত্ব নেওয়ার কথা বললে বাকি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওই দুজনের নামই আগে আসে। একজন দলের অধিনায়ক। আরেকজন তর্কযোগ্যভাবে সাম্প্রতিক অতীতে টেস্টে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান। অথচ সেই দুজনই কিনা দলকে অথই সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ায় অগ্রণী ভূমিকায়!
৩৫ উইকেটের প্রথম তিন দিন এই টেস্ট মনে রাখার মতো অনেক কিছুই দিয়েছে। মাত্র তৃতীয়বারের মতো একই টেস্টে একই দলের দুই ব্যাটসম্যান জোড়া সেঞ্চুরি করতে দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। স্পিননির্ভরতা থেকে পেসবান্ধব হওয়ার পথে আরেক ধাপ এগোতে দেখেছে বাংলাদেশকে। নাহিদ রানার গতিময় অভিষেককে বলতে পারেন যেটির প্রতীক। যদিও আজকের দিনটিকে আলাদা করে নিলে কথাটা আপনার কানে লাগতে পারে। বলে গতির ঝড়, কিন্তু লাইন-লেংথের ঠিক নেই—এমন ফাস্ট বোলারদের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা বলে, ‘ডা ওয়াইল্ড থিং!’ এখানে ক্যারিবীয় উচ্চারণে ‘ডা’ মানে ‘দ্য’। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছ থেকে ধার নিয়ে অন্য দেশের কোনো কোনো বোলারকেও পরে ডাকা হয়েছে এই নামে (সবচেয়ে বড় উদাহরণ অস্ট্রেলিয়ার শন টেইট)। নাহিদ রানাও এই ‘ডা ওয়াইল্ড থিং’-এর বাংলাদেশি সংস্করণ। আজ শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের যতটা ভুগিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন কিপিং গ্লাভস হাতে লিটনকে। তারপরও অনেক দিন পর এই টেস্টের কথা উঠলে ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা আর কামিন্দু মেন্ডিসের জোড়া সেঞ্চুরির মতো মনে পড়বে নাহিদ রানাকেও। এমন ফাস্ট বোলার তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে এর আগে আসেনি। তবে কেন যেন মনে হয়, ধনাঞ্জয়া-কামিন্দু-নাহিদ রানাকে ছাপিয়ে স্মৃতিতে সবচেয়ে বেশি থেকে যাবে প্রথম বলেই লিটনের ওই ব্যাখ্যাতীত শট। ক্রিকেটে এসব মুহূর্তকে বেশির ভাগ সময় ‘ব্রেন ফেড’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু সেটি তো স্বাভাবিক থাকতে থাকতে হঠাৎই অস্বাভাবিক কিছু করে ফেললে। উইকেটে নেমেই অমন করলে কি সেটিকে ‘ব্রেন ফেড’ বলা যায়! নাকি প্রায় ১১১ ওভার কিপিং করার কিছুক্ষণ পরই ব্যাটিংয়ে নামতে হওয়ায় লিটনের মাথা আর কাজ করছিল না!
আসলে কোনো ব্যাখ্যা হয় না। হয় না বলেই এই সিরিজ কাভার করতে আসা শ্রীলঙ্কার একমাত্র সাংবাদিক জানতে চান, দলে কি লিটনের কোনো ঝামেলা চলছে? ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা না পেলে লোকে তো অন্য কারণ খুঁজবেই।
নতুন কোকাবুরা বল ব্যাটসম্যানদের কেমন পরীক্ষা নেয়, তার প্রমাণ শ্রীলঙ্কার দুই ইনিংসেও আছে। প্রথম ইনিংসের মতো দুরবস্থা না হলেও দ্বিতীয় ইনিংসেও বলতে গেলে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের দাপট। দুই ইনিংস মিলিয়ে পরের ৫ উইকেটে শ্রীলঙ্কা তুলেছে ৫২৮ রান, যা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি, টেস্ট ইতিহাসে পঞ্চম সর্বোচ্চ।
শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের বলছি, আসলে তো শুধুই দুজন। জোড়া সেঞ্চুরি করতে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের প্রিয় প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশের আগেও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এখন তো আরও নেই। যে নয়বার শ্রীলঙ্কান কোনো ব্যাটসম্যান জোড়া সেঞ্চুরি করেছেন, সর্বশেষ পাঁচবারই তা বাংলাদেশের বিপক্ষে। ধনাঞ্জয়া ডি সিলভারটা এর মধ্যেও স্পেশাল। কোনো শ্রীলঙ্কান অধিনায়কের টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি যে এই প্রথম।
পারফরম্যান্সের বিচারে দুই বিপরীত মেরুতে থাকা দুই অধিনায়কই আসলে প্রতীকী হয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে দুই দলের অবস্থাও। বৃষ্টি না হলে আগামীকালই শেষ হয়ে যাচ্ছে এই টেস্ট, হয়তো প্রথম সেশনেই। দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে চট্টগ্রাম-যাত্রায় বাংলাদেশ দলের সঙ্গী হয়ে থাকবে বিশাল এক পরাজয়। সঙ্গে লিটন দাসের ওই ব্যাখ্যাতীত শটের স্মৃতিও!