রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী টেস্টের তৃতীয় দিনে আজ লিটন দাস যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, ২৫ রানেই ৫ উইকেট নেই বাংলাদেশের! ওই ২৫ রানে থাকতেই আরেক প্রান্ত থেকে সাকিব আল হাসানকেও আউট হতে দেখেছেন লিটন।
বৃষ্টিতে প্রথম দিন পরিত্যক্ত হওয়ায় পাঁচ দিনের টেস্ট চার দিনে নেমে আসার পরও মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য ফলোঅনে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে দলকে টেনে তোলেন লিটন। সপ্তম উইকেটে দুজন যোগ করেন ১৬৫ রান, যা টেস্টে ৫০ রানের কমে কোনো দলের ৬ উইকেট হারানোর পর সর্বোচ্চ।
এরপর বোলার হাসান মাহমুদ ব্যাট হাতে দারুণ সঙ্গে দিয়ে গেলে টেস্ট ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরির দেখা পান লিটন। এই স্টাইলিশ উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান শেষ পর্যন্ত আউট হন ১৩৮ রান করে। এতেই বদলে যায় ম্যাচের দৃশ্যপট। একসময় ফলোঅনের শঙ্কায় পড়া বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে মাত্র ১২ রানে পিছিয়ে থেকে প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়। দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নেমে স্বাগতিকেরা ৯ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে তৃতীয় দিন শেষ করায় সফরকারীরাই আছে সুবিধাজনক অবস্থানে।
তবে ১৩ চার ও ৪ ছক্কায় সাজানো ১৩৮ রানের ইনিংসকেও টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা মনে করেন না লিটন। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ১৪১ রানের ইনিংসটিকেই তিনি সবার ওপরে রাখছেন। আজ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আসা লিটন বলেছেন, ‘সত্যি বলতে এটা (সেরা) নয়। আমি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এমন পরিস্থিতি থেকেই ১৪১ রান করেছিলাম। সব মিলিয়ে (আজ) আমাদের সংগ্রহ ভালো হয়েছে। সুযোগ কাজে লাগাতে পেরে আমি খুশি।’
ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ের সময় ক্রিজে যাওয়ার পর কেমন অনুভূতি হচ্ছিল? ২৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের সোজাসাপটা উত্তর, ‘ওই মুহূর্তে কিছুটা স্নায়ু চাপে ভুগছিলাম। কখনোই ভাবিনি আমাকে পানি পানের বিরতির আগেই ব্যাটিংয়ে নামতে হবে। মিরাজকে শুধু বলেছিলাম, ওরা এখন ভালো ছন্দে আছে। আমাদের কিছুটা সময় নিতে হবে। তারপর দেখা যাক, কী হয়।’
বাংলাদেশের ফলোঅনে পড়ার শঙ্কা জাগলেও এ নিয়ে ভাবেননি লিটন, ‘আমি কখনোই দীর্ঘ চিন্তাভাবনা করিনি। সাকিব ভাইয়ের সঙ্গে যখন (নিজের ইনিংস) শুরু করলাম, এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি আউট হয়ে গেলেন। এরপর মিরাজের সঙ্গে একটাই আলোচনা হয়েছে যে ইনিংস কতটা লম্বা করা যায়। ওরা সে সময় খুব ভালো বল করছিল। নতুন বলে খেলা সব সময় চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।’
গতকাল ৫ উইকেট নিয়ে প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের সংগ্রহ খুব একটা বড় হতে দেননি মিরাজ। আজ লিটনকে পাশে পেয়ে ৭৮ রানের ইনিংস খেলে ব্যাট হাতেও বড় অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশকে সুবিধাজনক অবস্থানে নেওয়ার কৃতিত্বটা তাই মিরাজকেও দিচ্ছেন লিটন, ‘অনেকটা কৃতিত্ব মিরাজের। কারণ, হাতে আঘাত পাওয়ার কারণে আমি ঠিকমতো ব্যাট করতে পারছিলাম না। ওই সময় মিরাজই ওদের মোমেন্টাম নষ্ট করে দিয়েছে। শুরুর দিকে ওর কয়েকটা বাউন্ডারি আমাদের ছন্দে ফিরিয়েছে। জানতাম, আমরা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছি। কিন্তু এটাকে আমরা সুযোগ হিসাবে নিয়েছি। আপনি যদি বড় মাপের খেলোয়াড় হন, তাহলে এ ধরনের সুযোগ কাজে লাগাতে হয়।’
মিরাজ আউট হওয়ার পরপরই তাসকিন আহমেদও ফিরলে লিটনের সেঞ্চুরি পাওয়া নিয়ে সংশয় জেগেছিল। কিন্তু পেসার হাসান মাহমুদ আজ স্বীকৃতি ব্যাটসম্যানের মতো খেলেছেন। ৫১ বলে ১৩ রানে অপরাজিত ছিলেন হাসান। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২ ঘণ্টা ক্রিজে টিকে থেকে সেঞ্চুরি পূরণে লিটনকে সহায়তা করা।
হাসানকে প্রশংসায় ভাসিয়ে লিটন বলেছেন, ‘হাসান (ব্যাটিংয়ে) আসার পর আমি পুরোপুরি রক্ষণাত্মক মানসিকতায় চলে গিয়েছিলাম। আমি যখন স্ট্রাইকে ছিলাম, তখন সব ফিল্ডার (৩০ গজ বৃত্তের) বাইরে ফিল্ডিং করছিল। তখন আমার বাউন্ডারি বা কোনো কিছু বের করার কোনো সুযোগ ছিল না। হাসানকে কৃতিত্ব দিতে হবে। সে আমাকে অনেকক্ষণ খেলার সুযোগ দিয়েছে। আমার সঙ্গে তার একটাই পরিকল্পনা ছিল যে আমরা ১ রান, ২ রান নিয়ে এগোব। আমরা যতক্ষণ ব্যাট করব, ওদের লিডের পরিমাণ তত কমবে।’
রাওয়ালপিন্ডিতে আগামীকাল বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তবে আবহাওয়া নিয়ে না ভেবে এখন বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে ভালো করায় চোখ লিটনের, ‘দেখুন, বৃষ্টির বিষয়টা তো আর আমাদের হাতে নেই। আগামীকাল আমরা যদি শুরুতে ভালো বল করি, যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। নতুন বলে আমাদের বোলাররাও এই পিচ থেকে দারুণ সুবিধা পাচ্ছে। শুরুতে কয়েকটা উইকেট নিতে পারলে মোমেন্টাম আমাদের হাতে চলে আসবে। আমার মনে হয় সেখান থেকে আমরা সহজেই ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’
কাল স্পিনার মিরাজ পেয়েছেন ৫ উইকেট। আজ ৫ উইকেট নিয়েছেন পাকিস্তানের পেসার খুররম শেহজাদ। রাতারাতি কি তাহলে পিচের আচরণ বদলে গেল? লিটনের তেমনটা মনে হচ্ছে না, ‘আমার তেমনটা মনে হয় না। মনে হচ্ছে আগামীকাল এই পিচে স্পিন আরও ভালো ধরবে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা পিচ। আগের টেস্টে বল দেখেই মারা যেত। কিন্তু এই পিচে ছন্দ ধরে রেখে ব্যাট করতে হচ্ছে। এই পিচ কিছুটা মন্থর। তাই শট খেলার আগে ভাবতে হচ্ছে কোনটা মারব, কোনটা ছাড়ব।
পাকিস্তানকে দ্বিতীয় ইনিংসে যতটা কমে সম্ভব, বেঁধে ফেলার চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। লিটন এখন সেই অপেক্ষাতেই আছেন, ‘বোলার ও ফিল্ডারদের দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা যদি সঠিক জায়গায় বল করতে পারি, তাহলে ওদের ভুগতে হবে। কারণ, এই উইকেটে ব্যাট করা সহজ নয়।’