বিশ্বকাপ যদি ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চ হয়, সেটি আয়োজনের জন্য ভারতের চেয়ে আদর্শ দেশ আর হয় না। খুঁজলে ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটি হয়তো পাওয়া যাবে। এই উপমহাদেশের কোনো আয়োজনই কি আর ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো নিখুঁত হয়! কিন্তু বিশ্বকাপ যদি বিশ্ববৈচিত্র্য মঞ্চায়নের জায়গা হয়, তাহলে ভারতের কোনো তুলনা নেই। এত বৈচিত্র্য আর কোনো দেশে আছে?
বিশ্বকাপের একেকটা শহর যেন আলাদা একেকটা দেশ। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস। জীবনাচরণের এই ভিন্নতা ক্রিকেটেও যেন প্রতিফলিত। এক শহর থেকে আরেক শহরে খেলতে যাচ্ছে দলগুলো। যাওয়ার সময়ই জানে, নতুন এই ভেন্যুতে চ্যালেঞ্জটাও নতুন হবে। আর ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় রহস্য বা চ্যালেঞ্জের নাম তো বরাবরই একটা—উইকেট।
১০ দলের রবিন রাউন্ড লিগের বিশ্বকাপে সব দলই সব দলের সঙ্গে খেলবে। বিশ্বকাপের ফিকশ্চার চূড়ান্ত হওয়ার পর কার সঙ্গে খেলা পড়েছে, এই কৌতূহল তাই ছিল না। কৌতূহল বলতে কোন দলের সঙ্গে কোন মাঠে খেলা। হিসাব-নিকাশটা প্রতিপক্ষ আর মাঠের চরিত্র মিলিয়েও করেছে সব দল। বিশ্বকাপের ফিকশ্চার হাতে পাওয়ার পরই বাংলাদেশ দল যেমন জানত, তৃতীয় ম্যাচে তাদের ভালো সুযোগ আছে। কারণ, ম্যাচটা চেন্নাইয়ে। প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক মাঠেই স্পিন উইকেট তৈরি করেছে ভারত। তবে চিপকের এই চিদাম্বরম স্টেডিয়ামকে সে জন্য আলাদা করে প্রস্তুত করতে হয়নি। ঐতিহ্যগতভাবেই এই মাঠের উইকেট স্পিনবান্ধব।
এই বিশ্বকাপে চেন্নাইয়ে প্রথম ম্যাচটাও এর প্রমাণ হয়ে এসেছে। ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ ধর্মশালার হোটেলে টেলিভিশনে দেখেছে বাংলাদেশ দল। দেখেছে ভারতীয় স্পিন কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে অস্ট্রেলিয়াকে। সাম্প্রতিক সময়ে পেস বোলিংয়ে যতই জাগরণের কথা বলা হোক, টার্নিং উইকেটেই বরাবরের স্বাচ্ছন্দ্য বাংলাদেশের। দেশের বাইরে গেলেও যে কারণে ‘মিরপুর’ খোঁজা হয়।
একই মাঠে দুই উইকেটও চরিত্রে অনেক সময় একটু ভিন্ন হতে পারে। তবে তা কতটাই আর বদলাবে? ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে প্রায় মিরপুরের চেহারা নেওয়া চেন্নাইয়ের উইকেট আজও তেমনই থাকবে বলে ধরে নিচ্ছে দুই দল। নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান চেন্নাইয়ে এসেই যেমন বলেছেন, ‘এখানে আমাদের যে দুটি দলের সঙ্গে খেলা, তারা টার্নিং উইকেটে বিশ্বমানের দল।‘
এই দুই দলের একটি বাংলাদেশ। অন্যটি আফগানিস্তান। চেন্নাইয়ে পরপর এই দুই দলের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের খেলা। ড্যারিল মিচেল ওই কথাটা বলার পরই অবশ্য যোগ করে দিয়েছেন, ‘আমাদের দলেও ভালো স্পিনার আছে।’ সেই ‘ভালো স্পিনার’দের মধ্যে সবার আগে নাম করতে হয় মিচেল স্যান্টনারের। আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসে খেলার সুবাদে এই মাঠ যাঁর খুব ভালো চেনা। লেগ স্পিনার ইশ সোধি আছেন। অফ স্পিনার গ্লেন ফিলিপস। স্পিন–বৈচিত্র্যে নিউজিল্যান্ড হয়তো তাই বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়েই। ও হ্যাঁ, রাচিন রবীন্দ্রর কথা দেখি ভুলেই গেছি। ভুলে যাওয়ার কারণও আছে। প্রথম দুই ম্যাচে দুর্দান্ত ব্যাটিং পারফরম্যান্সের কারণে রাচিন রবীন্দ্রর বোলিং-সত্তা একটু আড়ালেই চলে গেছে। স্যান্টনারের মতো রাচিন রবীন্দ্রও বাঁহাতি স্পিনার।
নিউজিল্যান্ডের টিম ম্যানেজমেন্টকে যিনি ফেলে দিয়েছেন মধুর সমস্যায়। হাঁটুর চোটের কারণে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকার পর বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই খেলায় ফিরছেন কেইন উইলিয়ামসন। নিউজিল্যান্ড দলের ব্যাটিং অর্ডারে ৩ নম্বর জায়গাকে অনেক বছরই নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে রাচিন রবীন্দ্রর সেঞ্চুরি আর হাফ সেঞ্চুরিও যে ৩ নম্বরে ব্যাটিংই করে। তাহলে কী হবে?
কেইন উইলিয়ামসন সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, উইকেট বুঝে দলের ভারসাম্য ঠিক রাখতে যা করা উচিত, তা-ই করা হবে। চেন্নাইয়ে খেলা পড়ায় বাংলাদেশ দল খুশি হয়েছিল বলেছিলাম। সেই খুশির মধ্যেও কিন্তু একটা আফসোস ছিল। নিউজিল্যান্ড না হয়ে এখানে ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকাকে পাওয়া গেলেই বেশি ভালো হতো। বিশ্বায়নের এই যুগে সব দলই এখন স্পিন খেলা শিখে গেছে। তারপরও এই তিন দলের মধ্যে নিউজিল্যান্ডই স্পিনটা বেশি ভালো খেলে বলে সাধারণ ধারণা। স্পিন ভালো খেলার কথা বললেও প্রথম নামটা আসে ওই কেইন উইলিয়ামসনেরই।
অধিনায়ককে ছাড়াই প্রথম দুই ম্যাচে যে দাপটে জিতেছে নিউজিল্যান্ড, তাতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জটা আরও বড় হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দারুণ জয়ে বিশ্বকাপ শুরুর পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৭ রানের পরাজয়ের ধাক্কাটা একটু তো টালমাটাল করে দেওয়ার মতোই। যদিও এই বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বাংলাদেশ দল দুইটা মন্ত্র ঠিক করে নিয়েছিল। যার একটা হলো, জেতো বা হারো, খুব দ্রুতই আগের ম্যাচটা পেছনে ফেলে শুধু পরের ম্যাচটা নিয়েই ভাবতে হবে। ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে দলের সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন সেই মন্ত্র্রই আওড়ে গেলেন, ‘এটা লম্বা টুর্নামেন্ট। আমরা তো আর সব ম্যাচে জিতব না। পরের ম্যাচটা নিয়ে ভাবাটাই জরুরি।’
সাধারণ ক্রিকেটীয় বিচারবুদ্ধিতে আজকের ম্যাচটা জেতার কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের সামনে। পরের দুই ম্যাচ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এখন পর্যন্ত এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স বিচারে ম্যাচ দুটি খুব কঠিন হওয়ার কথা। নেদারল্যান্ডস ছাড়া সব দলই তো কঠিন। যদিও মাত্রই নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে আসার পরও উইলিয়ামসন বলছেন, ‘এই বিশ্বকাপের দলগুলো যে কেউ যে কাউকে হারাতে পারে।’
জয়ের বিকল্প নেই বলতে আসলে বোঝানো হচ্ছিল সেমিফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখাকে। এই ম্যাচ হেরে গেলে যা অনেকটা ধূসর হয়ে যাবে। নাজমুল অবশ্য অত দূর ভাবতেই রাজি নন, ‘প্রতিটি ম্যাচ জেতাই জরুরি। সেমিফাইনাল নিয়ে এখনই চিন্তা করা উচিত নয়।’
নিজেদের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে না নেওয়ার সেটিই পথ। তবে আজ মাঠে নামার সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অবচেতন মনে ওই চিন্তাটা কাজ না করে পারেই না।