পাকিস্তান টানা চার ম্যাচে হেরেছে, এটা কি বাংলাদেশ দলের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে?
সাকিব আল হাসান একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘একই কথা ওরাও বলতে পারে। আমরা তো পাঁচটা হেরেছি, সেই সুবিধা ওরাও নিতে পারে।’
বলতে বলতে আবারও হাসি। এবার আরও প্রাণ খুলে। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘মাঝে মাঝে একটু হাসির দরকার আছে।’
সংবাদ সম্মেলন থেকে হাসিমুখে সাকিবের বেরিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে মনে প্রশ্ন জাগছিল, দুই দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে যাঁকে দেখেছিলাম, সেই মানুষটাই তো! সেদিনের বিষণ্ন-হতাশ-বিপর্যস্ত সাকিব কোন জাদুমন্ত্রবলে এমন বদলে গেলেন! আজ তো তিনি কথায়–কথায় হাসছেন।
নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে যাওয়ার পর সাকিবের সংবাদ সম্মেলনটা তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনেই ব্যতিক্রমী। জীবনে আর কোনো সংবাদ সম্মেলনে এতবার ‘আপনি ঠিক বলেছেন’, ‘আপনার সঙ্গে একমত’, ‘দ্বিমত করার সুযোগ নেই’ বলেছেন বলে মনে হয় না। সাংবাদিকেরা একের পর এক প্রশ্নবাণ ছুড়ছেন আর সাকিব তা বুক পেতে নিচ্ছেন। ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটা ম্যাচও জেতেনি, হেরেছে কানাডা-কেনিয়ার কাছেও। এবার তো বাংলাদেশ একটি ম্যাচ জিতেছে, জেতার সুযোগ আছে আরও। অথচ সাকিব নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন, এবারেরটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ। কৌশলই হয়তো। কিন্তু তা করতে সাহস লাগে।
এই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ম্যাচের আগে-পরে বাকি সব দলের অধিনায়কেরা সংবাদ সম্মেলনে নিয়মিত। একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে ছিলেন সাকিব। বাংলাদেশের প্রথম চারটি ম্যাচে তাঁর দেখাই পায়নি কেউ। টানা তিন ম্যাচ হারার পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে প্রথম। এরপর সাত দিনের মধ্যে তিনবার। দল যখন পরাজয়ে পরাজয়ে বিপর্যস্ত, সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে দূর দিগন্তে, সংবাদ সম্মেলন যেন কাঠগড়া—সাকিব সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলাদেশের জন্য এই ভগ্নমনোরথ বিশ্বকাপের দায়দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। আমি অধিনায়ক, ঝড় যা যাওয়ার আমার ওপর দিয়েই যাক।
নতুন লক্ষ্যটা জানিয়ে দেওয়াও হয়তো একটা উদ্দেশ্য। সেমিফাইনাল নিয়ে আলোচনা তো শেষ, বাকি তিন ম্যাচ তাহলে কী পাওয়ার জন্য খেলবে দল? সেই লক্ষ্যটাও নিজেই ঠিক করেছেন। এই বিশ্বকাপে আর কোনো অধিনায়কের মুখে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথা শোনা যায়নি। সাকিব যেখানে সংবাদ সম্মেলনে প্রথম এসেই যেটির কথা বলতে শুরু করেছেন। সেমিফাইনাল খেলতে না পারলেও অন্তত প্রথম আটের মধ্যে থেকে ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে চাই। এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি দিয়েই খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানতে চান, কারণ হয়তো এটাও।
আজ ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষের অবশ্য চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। অঙ্কের হিসাবে হলেও এখনো পাকিস্তানের সেমিফাইনাল খেলার আশা আছে, এটা তো অবশ্যই একটা কারণ। তার চেয়েও বড় কারণ, ১০ দলের মধ্যে ১০ নম্বর হলেও স্বাগতিক হিসেবে তারা ঠিকই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলবে। বিশ্বকাপের প্রথম সাত দল আর পাকিস্তান, এই হলো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আট দল। পাকিস্তান ওপরে থাকলে কোয়ালিফাই করবে ৮ নম্বর দলটিও।
সাকিব ৮ নম্বর হতে চান না, এর ওপরে শেষ করতে চান। সে জন্য জিততে হবে। ম্যাচ বাকি তিনটি। শক্তির তুলনামূলক বিচারে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের আশাটাই হয়তো বেশি বাস্তবসম্মত। প্রথম দুই ম্যাচ জিতে উড়তে থাকা পাকিস্তান যেভাবে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাতে আজও কি একটা বড় সুযোগ নয়? সুযোগ তো অবশ্যই। তবে ইতিহাস কিন্তু এটাও বলে যে পরাজয়ে-বিতর্কে এমন কোণঠাসা পাকিস্তানের চেয়ে বিপজ্জনক দল বিশ্ব ক্রিকেটে আর নেই।
কাল পাকিস্তান দলের কোচ গ্র্যান্ট ব্র্যাডবার্নের কথাবার্তায় অবশ্য কোনো হুমকি নেই। বরং নিজেই যেন নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করে গেলেন। বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট হিসেবে শুরু করে এখন এমন অবস্থা কেন জানতে চাওয়ায় যে উত্তরটা দিলেন, তা খুবই ইন্টারেস্টিং। কে ফেবারিট বলেছে, কেন বলেছে, তা তিনি জানেন না। পাকিস্তান এপ্রিলেও র্যাঙ্কিংয়ে ৫ নম্বরে ছিল। বিশ্বকাপের আগে ১ নম্বরে উঠে এলেও তাতে ‘ফাঁকি’ ছিল। কারণ, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে খেলেইনি, খেলেনি আরও অনেক বড় দলের সঙ্গে। এসব বলার অর্থ একটাই। এমনিতেই গলায় ফাঁস হয়ে বসেছে বিষম চাপ। প্রত্যাশার ডানা ছেঁটে ফেলে সেটি যদি একটু আলগা করা যায়!
বোর্ডের অপেশাদারত্ব, মাঠের বাইরের বিতর্ক—এসবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল আছে। তা আরও বেশি মিলে গেল ব্র্যাডবার্নের কথায়। মাত্র মাস ছয়েক আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। এই বিশ্বকাপে ভালো করতে যেখানে চার বছর আগেই সবকিছু ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল। মিলটা বুঝতে পারছেন তো? চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মুখেও কি আপনি একই কথা শোনেননি!