দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তর
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তর

এয়ারপোর্টেও যখন কাটানো যায় ‘ছুটি’

কোনো কাজ-কর্ম ছাড়াই দুবাইয়ে দুই রাত থাকায় একটা ব্যাপার অন্তত জানা হলো—দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সুসজ্জিত আলো ঝলমলে ডিউটি ফ্রি শপগুলোতেও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য পাওয়া যায়।

ট্রানজিট প্যাসেঞ্জাররা এয়ারপোর্টে ঢোকেন দৌড়াতে দৌড়াতে, এয়ারপোর্ট থেকে বেরও হন দৌড়াতে দৌড়াতে। কখনো ট্রানজিটের সময় একটু বেশি হলে কেনাকাটা বা চা-কফি যা খাওয়া হয়, সেসবেও একটা তাড়াহুড়ার ভাব থাকে। মোট কথা এয়ারপোর্ট তাদের জন্য আরাম করে কিছু করার জায়গা নয়।

সেদিক দিয়ে প্রবল ব্যতিক্রম বলতে পারেন আমাকে এবং আমার সফরসঙ্গী বাংলাদেশের আরেকটি জাতীয় দৈনিকের ক্রীড়া সাংবাদিক মাসুদ পারভেজকে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে এসেও আমাদের কোনো দৌড়াদৌড়ি-তাড়াহুড়ো নেই। আমরা এখানে হেলতে-দুলতে চলি, দেশ-বিদেশের রং-বেরঙের মানুষ দেখি, গল্প করি, খাই আর ঘুমাই।

অবসর এতটাই অখণ্ড যে, কোনো কেনাকাটার উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও আমি চকলেটের দোকানে ঢুকে চকলেটের কৌটা উল্টে দেখার সুযোগ পাচ্ছি এবং আবিষ্কার করছি যে, এমন জায়গাতেও মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া চকলেট বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়! অবশ্য বিষয়টা দোকানের একজনের নজরে আনতেই তাঁর লজ্জিত আর বিব্রত চেহারা বলে দিল ভুলটা একদমই অনিচ্ছাকৃত। ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গেই তাক থেকে সরিয়ে ফেললেন কৌটোটা।

যাই হোক আমরা দুই ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার কেন দুবাইয়ের আলিশান বিমানবন্দরে গত তিন দিন ধরে এমন ছুটি কাটানোর মেজাজে আছি, সেটা বলি। গোলটা বাঁধিয়েছে আসলে ফ্লাইদুবাই, যে এয়ারলাইনসের প্লেনে চড়ে আমরা কলম্বো থেকে এখানে এসেছি।

দুবাই এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপ

কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দর থেকে আমাদের দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে। এরপর দুবাই থেকে সন্ধ্যায় লাহোরের ফ্লাইট ছিল, যেখানে আজ এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খেলবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। কিন্তু শুক্রবার সকাল সকাল ক্যান্ডি থেকে কলম্বো বিমানবন্দরে এসে জানলাম ফ্লাইট যথা সময়ে ছাড়বে না, কখন ছাড়বে সেটারও ঠিক নেই।

ফ্লাইদুবাইয়ের যে বিমানে আমাদের লাহোরের পথে দুবাই পর্যন্ত আসার কথা, সেটা নাকি দুবাই থেকে উড়েও আকাশে চক্কর দিয়ে কি এক কারিগরি জটিলতায় আবার দুবাইয়েই নেমে গেছে। কলম্বোয় আর আসছে না। এয়ারক্রাফট বদলে সেই ফ্লাইট নতুন করে দুবাই থেকে যাত্রা করে কলম্বো গিয়েছে, তারপর আমরা আমাদের ফ্লাইট পেয়েছি।

কলম্বো-দুবাই বা দুবাই-কলম্বো ফ্লাইটের সময়সীমা ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। এবার হিসেব করে দেখুন নির্ধারিত সময়ের কত সময় পর আমরা দুবাই পৌঁছাতে পারি। কলম্বো থেকে আমাদের ফ্লাইট শেষ পর্যন্ত ছেড়েছে শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায়, মানে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৭ ঘণ্টা পর। আমরা দুবাই পৌঁছেছি স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ৮টার দিকে।

দুবাই এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য

ততক্ষণে দুবাই থেকে আমাদের পিআইএ-এর লাহোরের ফ্লাইট ছেড়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার সে ফ্লাইট আমরা মিস করেছি। টিকিট যেহেতু একই সঙ্গে কাটা ছিল, নিয়ম অনুযায়ী আমাদের লাহোর পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে ফ্লাইদুবাইকে। তাদের দেরির কারণেই তো আমরা সময়মতো লাহোর যেতে পারলাম না! লাহোরের ফ্লাইট পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের ব্যবস্থাতেই বিমানবন্দরের ভেতর দুবাই ইন্টারন্যাশনাল হোটেল আমাদের ঠিকানা। যতক্ষণ না আমাদের লাহোরের ফ্লাইটে তুলে দিতে পারছে, আমাদের দায়িত্ব ফ্লাইদুবাইয়ের।

পরশু রাতে দুবাই পৌঁছানোর পর থেকে কাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই ফ্লাইটের খবর নিতে টার্মিনাল থ্রি’র এ মাথা-ও মাথা করেছি। একবার একজনের ভুল পরামর্শে এয়ারপোর্ট বাসে চড়ে টার্মিনাল টুতেও চলে গেলাম। এত বড় এয়ারপোর্ট, এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে বাসে যেতেও প্রায় ১৫-২০ মিনিট। তাও যদি লাহোর ফ্লাইটের কোনো কূল-কিনারা হয়! কিন্তু কাল দুপুর পর্যন্ত হয়নি কিছুই। ফ্লাইদুবাইয়ের ইমেইলের নাকি তখনো রিপ্লাই-ই দেয়নি পিআইএ।

অবশেষে সুখবর এল কাল বিকেলে। পিআইএ আমাদের আজ রোববার লাহোর নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু ফ্লাইট ছাড়বে দুবাইর সময় বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিট, মানে আমরা লাহোর রওনা দেওয়ার আগেই বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচের অনেকটুকু হয়ে যাবে।

খেলা কাভার করতে দেশ থেকে বেরিয়ে সেটাই করতে না পারার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হয় না। তার ওপর বাংলাদেশ আজ হেরে গেলে এটাই হয়ে যাবে এবারের এশিয়া কাপে তাদের শেষ ম্যাচ। তখন পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াবে? আমরা লাহোর পৌঁছাতে পৌঁছাতেই টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশের বিদায়!

তবে বাংলাদেশ দলের ভাগ্যে যদি আজ হার লেখাই থাকে তা তো আমরা সেখানে আগে গিয়েও ঠেকাতে পারব না। তার চেয়ে দুবাই বিমানবন্দরে দুই রাত দুই দিন থাকার কিছু ইতিবাচক দিক খোঁজা যাক।

দুবাই ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের করিডর

প্রথমত আমি মনে করি, এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ দল এশিয়া কাপ থেকে আজই বিদায় নিলে আমাদের টুর্নামেন্টের বাকি অংশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কাজে দেবে। বাংলাদেশ নেই মানে তো বিদেশি দলগুলোর খেলা দেখা, তাদের অনুসরণ করা। দুবাইয়ের অখণ্ড অবসরে আমরা কি সেরকমই কিছু করছি না!

আমার একটা সমস্যা হলো কোনো এয়ারপোর্টে অনেক বেশি সময় কাটিয়ে দিলে হঠাৎ ভুলে যাই কোন দেশে আছি! এয়ারপোর্টটা কোন দেশের! বড় বড় এয়ারপোর্টে সারাক্ষণই নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানা পোশাকের মানুষ আসা-যাওয়া করতে থাকে। এমন বৈশ্বিক মিলনমেলায় বেশিক্ষণ থাকলে মেলাটা কোথায় হচ্ছে সেটি গৌণ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। আর এত মানুষের পদচারণায় এয়ারপোর্টটা যে দেশের, সম্ভবত সে দেশের মানুষই থাকে সবচেয়ে কম।

ডিউটি ফ্রি শপের এরিয়ার মধ্যে থাকলে তো আরও বিপদ। আশপাশে বিশ্বের বড় বড় সব ব্র্যান্ডের দোকান। সব দেশেই এগুলো আছে এবং সাধারণ চোখে কোনোটাই কোনো নির্দিষ্ট দেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। বাংলাদেশ না থাকলে বাকি এশিয়া কাপেও আমাদের জন্য ব্যাপারটা তেমনই দাঁড়াবে। বিদেশ আর বিদেশি ক্রিকেটেরই দর্শন হবে শুধু।

দুবাই এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য

এয়ারপোর্টে দেশ বোঝার একটা সহজ উপায় অবশ্য আছে—স্যুভেনির শপ। আমার মতো এয়ারপোর্টে থেকেও কোন দেশের এয়ারপোর্ট তা গুলিয়ে ফেলার সমস্যায় পড়লে নিকটস্থ স্যুভেনির শপে চলে যাবেন। সেখানে অন্তত এয়ারপোর্টটা যে দেশে, সে দেশের একটা ক্লু পাবেন।

বুর্জ খলিফা বা উঁটের ফ্রিজ কোস্টার দেখলে মনে পড়বে আপনি দুবাইতে আছেন। যদি দেখেন জিরাফের পুতুল বা বিগ ফাইভের মূর্তি, সেটা জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্ট না হয়ে পারেই না। দোকানে টুইন টাওয়ার সদৃশ টেবিল ঘড়ি দেখলে বুঝে নেবেন আপনি আছেন কুয়ালালামপুরে। মেরিনা বে স্যান্ডসের কিছু আছে তো সেটা সিঙ্গাপুরই হতে হবে।

কলম্বোয় থাকবে চা পাতার নানা রকম কৌটো, হাতি আর টুকটুকের শো পিস। দোহা হলে শেখ জায়েদ মসজিদের মিনিয়েচার, সিডনি হলে অপেরা হাউস, লন্ডনের হিথ্রো হলে লাল ডাবল ডেকার বাস বা টেলিফোন বুথ। ক্যারিবিয়ান দেশের বিমানবন্দরে ঝোলানো চাবির রিঙে পেয়ে যাবেন সী বিচের নিদর্শন। এখন তো ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও রিকশার স্যুভেনির দেখা যায়। কাজেই কোথায় আছেন জানতে সব সময় গুগল ম্যাপে ঢোকার দরকার নেই। স্যুভেনির শপে ঢুকলেও চলবে।

এর আগে দুইবার দুবাই আসা ছাড়াও দুবাই এয়ারপোর্টে ট্রানজিট কাটিয়ে অনেকবারই অনেক দেশে গিয়েছি। কিন্তু শুরুতে যেটা বললাম, ট্রানজিট মানেই দৌড়ের ওপর থাকা। এয়ারপোর্ট দেখার সময় কই! এবার ফ্লাইদুবাইর সৌজন্যে সুযোগ হলো বিশ্বের অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ এয়ারপোর্টটাকে একটু ভিন্ন চোখে দেখার।

দুবাই এয়ারপোর্টটা ৭২০০ একর জুড়ে। শুনে অনেক বড় মনে হতে পারে, তবে বিশ্বে কিন্তু এর চেয়েও বড় এয়ারপোর্ট অনেক আছে। তবু দুবাই এয়ারপোর্টের ভেতর দিয়ে বাসে এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যাওয়া-আসার পথে এর খুব অল্প অংশই দৃষ্টিসীমায় এসেছে। তার মধ্যেই কত-না দেশের বিমান পাখির মতো উঠছে আর নামছে! টার্মিনালের গেটে সারিবদ্ধভাবে দরজা ভিজিয়ে রাখা অ্যামিরেটস এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজের লাইনটা যেন বিশাল কোনো কার পার্কিং! তার মধ্যে দোতলা এ৩৮০ উড়োজাহাজগুলোই গুণে শেষ করা যায়নি।

দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমিরেটসের উড়োজাহাজ

যারা নিয়মিত বিদেশে যাওয়া-আসা করেন তাদের জন্য এসব নতুন কিছু নয়। তবে বিশ্বাস করুন, আমাদের মতো দুই রাত দুই দিন যে কোনো এয়ারপোর্টে বেকার ঘোরাঘুরি করলে সবই একটু অন্যরকম ভাবে দেখতে পাবেন।

দুবাই ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের স্টাফ, বয়-বেয়ারাদের কাছে যেমন আমরাও নতুন ধরনের অতিথি। কারণ আমাদের দেখলে মনে হতেই পারে যে ট্রানজিট নয়, আমরা এয়ারপোর্টে এসেছি আসলে ছুটি কাটাতে।

দুবাই ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের নিচতলা

দেখা হলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে তারা সৌজন্যের হাসি যেমন হাসছেন, একই সঙ্গে তাকাচ্ছেন কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে। যার অনুবাদ বুঝে নিতে তেমন কষ্ট হয় না—এই দুই বেটা এখনো এখানে! ছুটি কাটাতে এসেছে নাকি?

আসলে বিমানবন্দরের হোটেল লাউঞ্জে তো বেশির ভাগ মানুষই আসে কয়েক ঘণ্টা, বড় জোর এক রাতের জন্য। সেখানে এখানকার লোকজন আমাদের দেখছে দুই দিন দুই রাত ধরে। সকালের নাশতা, লাঞ্চ এবং ডিনারে। এখানে এখন সবাই আমাদের পরিচিত মুখ এবং আমরাও তাদের। ট্রানজিটে ঠেকার সময় পার করার জায়গাই আমাদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অবসর যাপন কেন্দ্র।

তবে এমন অবসর প্রত্যাশিত নয় কারওই। ক্ষণে ক্ষণে তাই অপেক্ষা—কখন যাব লাহোরে? মনে প্রবল আশা—আজ জিতে যাক বাংলাদেশ। দুই রাত দুই দিনের বিশ্রামের পর এশিয়া কাপটা তাহলে নতুন করে শুরু করলেও করা যেতে পারে। আর নয়তো বাকি টুর্নামেন্ট করতে লাহোর-কলম্বো যাওয়া যা, দুবাই এয়ারপোর্টে থাকাও তা। শুধুই বিদেশ আর বিদেশি দেখা।