শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ১২৪/৯
বাংলাদেশ: ১৯ ওভারে ১২৫/৮
ফল: বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী
কে বলে, শুধু চার-ছয়ের বৃষ্টি হলেই টি-টোয়েন্টি জমে! শুধু ব্যাটিং দেখতেই মাঠে আসে দর্শক। গত কিছুদিন এমনভাবে কথাটা বিক্রি করা হয়েছে যে, আসল কথাটাই ভুলে যাওয়ার দশা। সেই কথাটা কী? ক্রিকেটের আসল মজা তখনই, যখন তাতে ব্যাট আর বলের সত্যিকার লড়াই হয়। উদাহরণ চান? কেন, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচটা দেখেননি নাকি!
টি-টোয়েন্টির যেখানে দিনকে দিন ক্রিকেট থেকে বেসবলে রূপ নেওয়ার উপক্রম, তখন ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে রুদ্ধশ্বাস এই ম্যাচ মনে করিয়ে দিয়েছে, কম রানের টি-টোয়েন্টিও কেমন বিনোদনদায়ী হতে পারে!
স্নায়ুক্ষয়ীও। সমাপ্তির বিচারে এর চেয়ে নাটকীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে তীব্রতার বিচারে এর চেয়ে ঝাঁজালো ম্যাচ খুব বেশি নয়। সম্ভাবনা-আশঙ্কার দোলাচলটাও যোগ করে নিন। সঙ্গে এই ম্যাচে জয়-পরাজয়ের বৃহত্তর অর্থটা। হেরে গেলেই এক দলের সুপার এইটে ওঠার স্বপ্ন কার্যত শেষ, আরেক দলের জন্যও যা হয়ে যাবে আপাত-অসম্ভব। সবকিছু মনে রাখলে এই ম্যাচকে কি বলা উচিত, সেটির উত্তর ক্রিকেট অভিধানে আগে থেকেই আছে। লো-স্কোরিং থ্রিলার!
লাস্ট বল থ্রিলার নয়। এমনকি লাস্ট ওভারও নয়। ম্যাচ তো শেষ হয়ে গেছে ১ ওভার বাকি থাকতেই। কেউ যদি শুধুই স্কোরকার্ড দেখে ম্যাচটা বুঝতে চান, ২ উইকেটে জয়-পরাজয় থেকে কিছুটা হয়তো তিনি বুঝবেন। কিন্তু পুরোটা একদমই নয়। এর আগের ৩৯ ওভারে কী ধুন্ধুমার এক লড়াই হয়েছে, কতবার আশা-নিরাশার দোলায় দুলেছে দুই দল--এসব তো আর স্কোরকার্ডে লেখা থাকে না।
১৯তম ওভার শুরুর আগেও তো ম্যাচ পেন্ডুলামের মতো দুলছে। ম্যাচে আছে দুই দলই। ১২ বলে ১১ রান-টি-টোয়েন্টিতে কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু গুরুতর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যদি উইকেটের ঘরে ‘৮’ থাকে। তার ওপর আগের ওভারেই পরপর দুই বলে উইকেট পড়ে গিয়ে হঠাৎই ছড়িয়ে পড়ে একটা আতঙ্কের স্রোত।
শ্রীলঙ্কার মূল চার বোলারেরই ৪ ওভার করে শেষ, ১৯তম ওভারটি করতে হলো তাই দাসুন শানাকাকে। প্রথম বলেই মাহমুদউল্লাহর ছক্কাটার তাঁর ঘটন-অঘটনে পূর্ণ ক্যারিয়ারে বিশেষ একটা জায়গা নিয়ে থাকার কথা। অপরাজিত ১৬ রানের এই ছোট্ট ইনিংসটাও। এটিই তো হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশের শেষ পাড়ানির কড়ি।
মাত্র ১২৪ রান তাড়া করতে নেমে ভালো একটা শুরুই হতোদ্যম করে দিতে পারত শ্রীলঙ্কাকে। উল্টো প্রথম ওভারেই সৌম্যকে তুলে নিয়ে শ্রীলঙ্কানরা এমনই উজ্জীবিত যে, পাওয়ার প্লের মধ্যেই আরও ২ উইকেট নেই। ভুল লাইনে ড্রাইভ করতে গিয়ে বোল্ড তানজিদ তামিম। অন দ্য আপ ড্রাইভের উচ্চাভিলাষে নাজমুল শর্ট এক্সস্ট্রা কাভারে ক্যাচ।
২৮ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর একটা পার্টনারশিপের জন্য বাংলাদেশের যে আকুতি, সেটির উত্তর হয়ে এসেছেন লিটন আর তাওহিদ হৃদয়। শ্রীলঙ্কার অন্য বোলাররাও ভালো, তবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বেশি দুশ্চিন্তা ছিল বোধ হয় হাসারাঙ্গাকে নিয়েই। সেই হাসারাঙ্গাকে নিয়ে হৃদয়ের ছেলেখেলা তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের ইনিংসের হাইলাইটস। তিন বলে তিন ছয়ের হ্যাটট্রিক করার পরের বলেই অবশ্য আউট। তবে ম্যাচ তো ততক্ষণে শেষ! এমন লো স্কোরিং ম্যাচে ২০০ স্ট্রাইক রেটে ২০ বলে ৪০-এরপর আর চিন্তা কী! ৫০ বল তখনো বাকি, বাংলাদেশের লাগে মাত্র ৩৪ রান। এই ম্যাচ তো হেসেখেলে জেতার কথা।
কিন্তু এদিন যে কোনো কিছুই সহজে হবে না। হাসারাঙ্গা ভালো খেলতে থাকা লিটনকে তুলে নেবেন। সাকিব আল হাসান নিজেকে হারিয়ে খোঁজার আরেকটি প্রদর্শনীতে ম্যাচ শেষ করে আসার সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারবেন না। পরপর দুই বলে রিশাদ ও তাসকিনকে আউট করে দিনটিকে নিজের করে নেওয়ার হুমকি দেবেন নুয়ান তুষারা। ১৫ বলে তখনো ১২ রান লাগে। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর সঙ্গী যে শুধু দুই টেল এন্ডার। তাঁদের একজনকে অবশ্য নামতেই হয়নি শেষ পর্যন্ত।
এই মাঠেই আগের ম্যাচটা টাই হয়েছে। দুই দলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এদিনও সেই সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে থাকতেই পারে কারও মনে। মাঠে টাই না হলেও গ্যালারিতে মনে হয় সেটাই হয়েছে। বাংলাদেশি দর্শক দলের জার্সি পরাটাকেই যথেষ্ট বলে মনে করে। অনেকে সেটিও না পরে শুধু গলা ফাটানোকেই। যেখান শ্রীলঙ্কানদের সমর্থনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ জাতীয় পতাকা। দুই ইনিংসের শুরুতেই সেই পতাকা বাতাসে দোলানোর অনেক উপলক্ষ পেলেন শ্রীলঙ্কানরা। সংখ্যায় কম হয়েও গ্যালারিতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা প্রায় সমান-সমান মনে হওয়ার কারণ হতে পারে এটাও।
নাজমুল হোসেন নিজে ব্যাটসম্যান হলে কী হবে, চিন্তাভাবনায় তাঁকে ‘বোলিং ক্যাপ্টেন’-ই বলতে পারেন। তূণে সব ধরনের তিরই আছে বলে বাংলাদেশের এই বোলিং আক্রমণের ওপর তাঁর অসীম আস্থাও। প্রথম আলোর বিশ্বকাপ ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের সেই দর্শন পরিষ্কারই বলে দিয়েছিলেন, ‘টি-টোয়েন্টিতে যে দল ভালো বোলিং করে, জেতার সম্ভাবনাও সে দলেরই বেশি থাকে। আমাদের বোলাররা আগে বোলিং করে ১৫০-১৭০, যতটা কমে রাখতে পারবে, ব্যাটসম্যানদের কাজটা ততটাই সহজ হবে।’ টস জিতে নাজমুলের প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত তাই মোটেই অবাক করেনি। স্বীকার না করলেও পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে তাঁর মনে একটু খচখচানি শুরু হয়নি, এটা মেনে নেওয়াও একটু কঠিনই বটে।
বল সুন্দর ব্যাটে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগের ম্যাচে ৭৭ রানে অলআউট হওয়ার ঝাল মেটাতে যেন নেমেছেন পাথুম নিশাঙ্কা। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট কাটিয়ে ফেরা তাসকিন নিজের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলেই ফিরিয়ে দিয়েছেন আরেক ওপেনার কুশল মেন্ডিসকে। তারপরও ৫ ওভারেই স্কোরবোর্ডে উঠে গেছে ৪৮ রান। এর মধ্যে সাকিবের এক ওভারেই পাঁচ বলে চার চারে নিশাঙ্কা নিয়েছেন ১৬ রান। এর আগেই ওভার থ্রোতে অতিরিক্ত ৪ রান হয়েছে, বাংলাদেশকে একটু উদভ্রান্ত লাগছে। ক্রিকইনফোর কমেন্টারিতে গালিব নামে এক পাঠক তখন লিখছেন, ‘ধন্যবাদ সাকিব। আমি এখন ঘুমাতে যেতে পারব।’
বাধ্য হয়েই মোস্তাফিজকে একটু আগেই আনতে হয়েছে আক্রমণে। প্রথম বলেই কামিন্দু মেন্ডিসকে আউট করে শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় উইকেটও তুলে নিয়েছেন তিনি। মাঝখানে দুই ওভার বিরতির পর আবারও বোলিংয়ে ফিরে নিশাঙ্কাকে ফিরিয়ে হাবুডুবু বাংলাদেশকে একটু স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগও করে দিয়েছেন এই বাঁহাতি পেসার। ২৮ বলে ৪৭ রান করে নিশাঙ্কা যখন ফিরছেন, শ্রীলঙ্কা তখন ৩ উইকেটে ৭০। প্রথমে বোলিং করলে নাজমুল যে কল্পিত যে রানের অঙ্কটার কথা বলেছিলেন, সেটি তখনো খুবই সম্ভব। হয়তো তার চেয়েও বেশি।
সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা যে ১২৪ রানের বেশি করতে পারল না, সেই কৃতিত্ব বাংলাদেশের সব বোলারেরই কিছু না কিছু প্রাপ্য। সাকিব ছাড়া নিয়মিত বোলারদের সবাই উইকেট পেয়েছেন। ১৭ রানে ৩ উইকেট নিয়ে অঙ্কের হিসাবে সেরা মোস্তাফিজুর। বল ধরে ধরে বিচার করলেও হয়তো তা-ই। তবে শ্রীলঙ্কার ইনিংসকে হঠাৎই এমন পথহারা পথিক বানিয়ে দেওয়ার কাজটা হয়েছে এরও আগে। যা করেছেন রিশাদ হোসেন। পরপর দুই বলে আশালঙ্কা আর হাসারাঙ্গাকে আউট করেই আসলে ম্যাচটাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছেন এই লেগ স্পিনার। পরের ওভারে আরেকটি উইকেট নিয়ে আরও বেশি।
ওভারথ্রোর অংশটুকু বাদ দিলে বাংলাদেশ দারুণ ফিল্ডিং করেছে। ক্যাচ পড়েনি একটাও। শ্রীলঙ্কার মারমুখী মূর্তির সামনেও নিজেদের পরিকল্পনায় অটল থেকে আক্রমণাত্মক বোলিং চালিয়ে যাওয়ায় বাহবা প্রাপ্য অধিনায়ক নাজমুল হোসেনেরও। বোলারদের ১ ওভারের স্পেল করিয়ে যাওয়ার ধারণাটাও কাজে লেগেছে বলতে হবে। ১৭তম ওভারের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো বোলারই টানা দুই ওভার বোলিং করেননি।
ডেথ ওভারের অপেক্ষায় না থেকে ১৫ ওভারের মধ্যে মোস্তাফিজকে ৩ ওভার করিয়ে ফেলা, উইকেটে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান থাকার পরও লেগ স্পিনারের হাতে বল তুলে দেওয়া--জয়ের বাইরেও এই ম্যাচে ব্যতিক্রমী চিন্তার অনেক ছাপ আছে। শেষ পর্যন্ত জয়টা না পেলে অবশ্য এসবের কোনো মূল্যই থাকত না। সব জয়ই সমান বটে, তবে কিছু জয়ের মূল্য একটু বেশিই হয়।
এটাও তেমনই একটা জয়!