বাংলাদেশের বিপক্ষে কাল ১৭৪ রান করেছেন কুইন্টন ডি কক
বাংলাদেশের বিপক্ষে কাল ১৭৪ রান করেছেন কুইন্টন ডি কক

যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিচ্ছেন ডি কক

চোখ দুটি ঘুম ঘুম। মুখে এখনো যেন লেগে আছে কৈশোরের লাবণ্য। কুইন্টন ডি কককে দেখে অনুমান করাই কঠিন, ব্যাট হাতে নিলেই শিশুমুখের এই মানুষটি কেমন বদলে যান। হয়ে ওঠেন বোলারদের আতঙ্ক। এসব অবশ্য এখন আর কারও কাছে নতুন কথা বলে মনে হবে না। সেই কবে থেকেই তো বিশ্ব ক্রিকেট কুইন্টন ডি ককের এই দ্বৈত রূপের সঙ্গে পরিচিত। বিশ্বকাপ ক্রিকেটেরও যেটির সঙ্গে খুব ভালোভাবেই পরিচয় হচ্ছে এবার।

এর আগে যে দুটি বিশ্বকাপ খেলেছেন, তাতে কোনো সেঞ্চুরি ছিল না। এবার শুরুই করেছেন সেঞ্চুরি দিয়ে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরির বড় ভূমিকা দক্ষিণ আফ্রিকার রেকর্ড সংগ্রহে। পরের ম্যাচে তাঁর সেঞ্চুরির আগুনে পুড়েছে অস্ট্রেলিয়া। নেদারল্যান্ডস আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরের দুই ম্যাচে একটু যেন দম নিয়েছিলেন। প্রথমটিতে ২০ রানে আউট, দ্বিতীয়টিতে ৪ রানে। এই দুই ব্যর্থতার ঝাল মেটালেন বাংলাদেশের বোলারদের ওপর।

সেঞ্চুরি করতে লেগেছে ১০১ বল। এরপর যে রুদ্রমূর্তিতে দেখা দেবেন, তা তো জানা কথাই। পরের ৩৮ বলে করে ফেলেছেন ৭৪ রান। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে একটাই ডাবল সেঞ্চুরি হয়েছে। গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে সেটি করেছেন ভারতের ঈশান কিষান। কাল দ্বিতীয়টি হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছিল একসময়। কুইন্টন ডি কক ১৭৪ রান করে ফেলেছেন। ইনিংসের তখনো ৫ ওভার বাকি। ডি কককে ডাবল সেঞ্চুরিবঞ্চিত করার একটাই উপায় ছিল তখন। তাঁকে আউট করে দেওয়া।

ডি ককের একেকটা বাউন্ডারি এভাবে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না মুশফিকের

সেটাই করেছেন হাসান মাহমুদ। ১৪০ বলে ১৭৪ রানেই থেমে যেতে হয়েছে ডি কককে। ১৫টি চার আর ৭টি ছয় যোগ করলে দেখা যাচ্ছে, বাউন্ডারি থেকেই এসেছে এর ১‌০২ রান। এক বিশ্বকাপে তিন বা এর বেশি সেঞ্চুরি আছে সাত ব্যাটসম্যানের। তাঁদের মধ্যেও আলাদা কুমার সাঙ্গাকারা আর রোহিত শর্মা। ২০১৫ বিশ্বকাপে কুমার সাঙ্গাকারার ৪ সেঞ্চুরির যে রেকর্ড সহজে ভাঙবে না বলেই মনে হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে পরের বিশ্বকাপেই। রোহিত শর্মার পাঁচ সেঞ্চুরির সেই রেকর্ডও এখন কুইন্টন ডি ককের ব্যাটের দাপটে রীতিমতো কম্পমান।

রাউন্ড রবিন লিগেই ম্যাচ আছে আরও চারটি। পাঁচ ম্যাচে চার জয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনালও একরকম নিশ্চিত বলেই ধরে নেওয়া যায়। তার মানে কমপক্ষে আরও পাঁচটি ম্যাচ পাচ্ছেন ডি কক। সেঞ্চুরির নেশায় যেভাবে মেতে উঠেছেন, তাতে পাঁচ ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি পাওয়ার পক্ষেই নির্ঘাত বাজির দর বেশি হবে।

তা না পারলেই–বা কী! যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দেওয়ার যে স্বপ্নটা নিয়ে এসেছিলেন এই বিশ্বকাপে, তা তো এরই মধ্যে মোটামুটি পূরণ হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের আগেই হুট করে ঘোষণা করে দিয়েছেন, এটাই শেষ। এরপর আর ওয়ানডে খেলবেন না। টেস্ট ক্রিকেট ছেড়েছেন বছর দুয়েক আগে। বিশ্বকাপের পর থেকে শুধুই টি-টোয়েন্টি খেলবেন।

এ ধরনের সিদ্ধান্ত জানানোর সময় ক্রিকেটাররা নানা কারণের কথা বলেন। বেশির ভাগ সময়ই মূল কারণটা উহ্য রেখে। কুইন্টন ডি ককের চরিত্রটা আলাদা। যে কারণে খোলাখুলিভাবেই বলে দিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ টাকা। বয়স ৩০ হয়ে গেছে, ক্যারিয়ার আর কয় বছরই–বা আছে! এরপর যত দিন ক্রিকেট খেলবেন, তা খেলবেন বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেই। অর্থ আসবে, সঙ্গে পরিবারের সঙ্গে আরও সময় কাটানোর সুযোগও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক রেকর্ডের হাতছানি ছিল, থাকুক। নিজে যেটিকে ভালো মনে করেন, সেটিই করেছেন।

নিজে যা ঠিক মনে করেন, তা প্রকাশের ব্যাপারে দ্বিধাহীনতার প্রমাণ আগেও রেখেছেন কুইন্টন ডি কক। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বিশ্ব উত্তাল বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে। প্রায় সব খেলাতেই খেলোয়াড়েরা ম্যাচ শুরুর আগে হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ক্রিকেটও অনুসরণ করছে তা। কুইন্টন ডি কক বেঁকে বসলেন। তিনি হাঁটু গেড়ে বসবেন না। যে ম্যাচের আগে এ ঘটনা, সেটি আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে ডি কক। গত রাতে মুম্বাইয়ে

কুইন্টন ডি ককের ওই অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি আলোচিত হলো। তিনি বর্ণবাদী কি না, এ প্রশ্নও উঠল অবধারিতভাবেই। পরের ম্যাচ থেকে মাঠে ফিরলেন কুইন্টন ডি কক। ব্যাখ্যা করলেন তাঁর ওই অবস্থান নেওয়ার কারণ। বর্ণবাদের তীব্র বিরোধী তিনি নিজেও, কিন্তু এ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান বোর্ডের চাপাচাপি তাঁর ভালো লাগেনি। প্রতিবাদটা ওই কারণেই।

এই বিশ্বকাপের পর অন্য কারও কথা শুনতে হবে না। নিজে যা ভালো করেন, তা করার স্বাধীনতা থাকবে। সেই আনন্দটাই হয়তো সেঞ্চুরিতে উদ্‌যাপন করছেন কুইন্টন ডি কক।