সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবাল একসময় বন্ধু ছিলেন বলে জানেন সবাই। সেই সম্পর্ক হালকা হতে হতে এক পর্যায়ে বন্ধুত্বটা আর থাকেনি। শত্রু না হলেও দুজনের সম্পর্ক এখন জমাট বরফ।
তাঁদের দূরত্বটা প্রকাশ্যে চলে আসে যখন এক সাক্ষাৎকারে সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান স্বীকার করে নিলেন সাকিব ও তামিম একজন আরেকজনের সঙ্গে মাঠের বাইরে কথা বলেন না। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে সবকিছু আরও স্পষ্ট হলো। বিশ্বকাপে ‘আনফিট’ তামিমকে দলে চাননি সাকিব ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। পরে তো একটি টেলিভিশন চ্যানেল তামিম ‘টিমম্যান’ কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন সাকিব।
তামিম অবশ্য প্রকাশ্যে এ নিয়ে কিছু বলেননি। সম্প্রতি ভারতের খেলাধুলাবিষয়ক সাময়িকী ‘স্পোর্টস্টার’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করেননি তামিম। তবে কথা বলেছেন সাকিবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে।
তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সাকিবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা তাঁর দৃষ্টিতে আসলে কেমন। প্রায় দেড় দশক জাতীয় দলে একসঙ্গে খেলেছেন তাঁরা দুজন। ড্রেসিংরুমে বেশ কয়েক বছর তাঁদের মধ্যে কথা না হলেও সাকিবকে তামিমের চেয়ে ভালো জানেন খুব কম মানুষই।
সেই আলোকেই তামিম বলেন, ‘সম্পর্কের উত্থান-পতন আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কেউ একে অপরের ক্ষতি করছি না। কারণ, দুজনই শেষ পর্যন্ত দেশের হয়েই খেলছি। আমি মিডিয়াতে এ নিয়ে কথা বলিনি কিংবা জনসম্মুখে তাকে কিংবা অন্য কাউকে দোষারোপও করিনি।’ সাকিবের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘আমি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করি, সাকিব বাংলাদেশের জন্য যা করেছে, সেটা অসাধারণ। তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকুক আর না থাকুক, এটা অস্বীকার করা যায় না। সে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা।’
সাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তামিমকে এরপর যে প্রশ্নটি করা হয়েছে, তা শুনে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরাও নড়েচড়ে বসতে পারেন। প্রশ্নটা নিশ্চয়ই তাঁদের মধ্যেও আছে। সাকিব-তামিমের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশের ক্রিকেট কি আরও এগিয়ে যেত? শুনুন তামিমের মুখেই, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই—কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্কটা যদি আরও দীর্ঘায়িত হতো, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট বদলে যেত। আমরা দুজনই দেশের হয়ে ভালো করেছি, দুজনের মানসিকতাই ইতিবাচক এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সেরাটাই চাই।’
আমি মনে করি, আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্কটা যদি আরও দীর্ঘায়িত হতো, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট বদলে যেত।তামিম ইকবাল, ব্যাটসম্যান, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
দুজনের সম্পর্ক নিয়ে তামিমের কথা তো শুনলেন, এবার শুনুন সাকিবেরটাও। তবে তাঁর এই মন্তব্য আরও আগে করা। এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব’–এর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল সাকিবের কাছে। মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, তামিম ও সাকিব একতাবদ্ধ থাকলে তাঁদের ক্ষমতা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটকে পরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। সাকিব কি এর সঙ্গে একমত? সাকিব বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গে একমত।’
সাক্ষাৎকারে তামিম কথা বলেছেন নিজেকে নিয়েও। গত এক বছর তাঁর কেমন কেটেছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনি ভেবেছিলেন ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলে তারপর ক্যারিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাকিটা শুনুন তামিমের মুখেই, ‘...তারপর অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো মোটেও স্বস্তিদায়ক ছিল না।’
ঠিক কি কি ঘটেছিল, সাক্ষাৎকারে সেসবও জানতে চাওয়া হয় তামিমের কাছে। তামিম বলেন, ‘অনেক কিছুই ঘটেছে। একাধিক ব্যক্তি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং যে যার ভূমিকা খুব চাতুর্যের সঙ্গে পালন করেছেন। কিন্তু আমি তাদের দোষ দিই না। আজ পর্যন্ত কাউকে দোষারোপ করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। তারা জানে, আমার সঙ্গে কী করেছে এবং আমিও জানি, তারা কী করেছে। ব্যাপারটা এ পর্যন্তই থাক। আমি কর্মফলে বিশ্বাস করি এবং কারও খারাপ চাই না। কারণ, একদিন আমাকেও এমনকিছু তাড়া করতে পারে।’
চলতি ভারত সফরেই কানপুর টেস্ট শুরুর আগের দিন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ছাড়ার ঘোষণা দেন সাকিব। শেষ টেস্টটি দেশের মাটিতে খেলার ইচ্ছার কথা জানিয়ে এও বলেন, সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি হয়তো গত বিশ্বকাপেই খেলে ফেলেছেন। এখন পর্যন্ত যা আভাস, তাতে মনে হচ্ছে সাকিবের ঘরের মাঠে শেষ টেস্ট খেলার ইচ্ছা হয়তো পূরণ হবে।
তামিম মনে করেন, সাকিবের টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত সঠিক, ‘সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, লোকে এ নিয়ে অনেক কথাই বলেছে। যে কারোরই-অধিনায়ক, কোচ ও বোর্ড—নিজস্ব মতামত আছে। যখন সত্যিই মনে হবে সরে যাওয়ার এটাই সময়, তখন সে অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে যদি নিজের ইচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটা সঠিক এবং আমাদের সবারই এটাকে সম্মান জানানো উচিত।’
তামিমের চোখে এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সাকিব তাঁর সেরা খেলাটা খেলেছেন ২০০৯ সালের এক ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে, ‘২০০৯ সাল, ঢাকায় শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমরা প্রথম ম্যাচে হেরে যাই। ফাইনালে উঠতে আমাদের শ্রীলঙ্কাকে বোনাস পয়েন্টসহ হারাতে হতো। বৃষ্টি নামায় ম্যাচের দৈর্ঘ্য ৩১ ওভারে নামিয়ে আনা হয়। বোনাস পয়েন্টসহ জিততে ২৫ ওভারের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ১৪৭ রান তাড়া করতে হতো।’
যখন সত্যিই মনে হবে সরে যাওয়ার এটাই সময়, তখন সে অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে যদি নিজের ইচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটা সঠিক এবং আমাদের সবারই এটাকে সম্মান জানানো উচিত।তামিম ইকবাল, ব্যাটসম্যান, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে তামিম বলে যান, ‘বোনাস পয়েন্টসহ জয় ছিল তখন আমাদের কল্পনার অতীত। ১১ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর সাকিব ব্যাটিংয়ে নামে। সে ৬৯ বলে ৯২ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে ২৩.৫ ওভারে দলকে জিতিয়ে দেয়। আমরা শুধু ম্যাচটাই জিতিনি, বোনাস পয়েন্টসহ ফাইনালেও উঠেছিলাম। ড্রেসিংরুমে বসে মনে হয়েছিল জয়ের সুযোগ আছে, তবে ভাবিনি আমরা বোনাস পয়েন্টসহ জিতব। কিন্তু সাকিবের মাথায় অন্য কিছু ছিল। আমি সত্যিই মনে করি, (সাকিবের) সেই অপরাজিত ৯২ রান বাংলাদেশের যেকোনো ক্রিকেটারেরই সেরা ওয়ানডে ইনিংস। আসলে এটাই সাকিব আল হাসান। অন্যভাবে ভাবতে পারার ক্ষমতাই তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ওই ইনিংসটি আমি খুব খুব বড় করে দেখি।’