জেক লিনটট এখন মোহামেডানের
জেক লিনটট এখন মোহামেডানের

সাকিবের ডাক পেয়ে ক্রিকেটের ‘জেমি ভার্ডি’ লিনটটের মোহামেডান-জয়

গুগল ম্যাপ বলছিল, বিকেল পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। সে সময়ের খুব একটা বাকি নেই, পথ অবশ্য বেশ কিছুটা বাকি। জেক লিনটটের মেসেজ তখনই, ‘কী অবস্থা, ট্রাফিক নাকি?’ উত্তর দেওয়ার পর রিপ্লাই এলো, ‘হা হা, অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়।’

ঢাকার খ্যাপাটে যানজট লিনটটের চেনাই হয়ে উঠেছে।

এর আগে ফরচুন বরিশালের হয়ে বিপিএলে খেলে গেছেন, এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে এসেছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। থাকছেন গুলশান ক্লাবে। সাক্ষাৎকারের জন্য বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে যে কোনো সময়ে গেলেই হবে, বলেছিলেন এমন। যানজট সে সময়সীমাকেও ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। অবশেষে যখন পৌঁছানো গেল, লিনটট রুম থেকে নিচে নেমে এলেন দ্রুতই।

গত মৌসুমে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলতে আসার কথা থাকলেও কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ার ছাড়েনি। এবারও ইংলিশ গ্রীষ্মের প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন বাঁহাতি এই রিস্ট স্পিনার। হুট করেই তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন ঢাকায়।

কীভাবে? সাকিব আল হাসানের ভূমিকা আছে এখানে, ‘ব্যাপারটা খুবই দ্রুত ঘটে গেছে। সাকিবের (আল হাসান) কাছ থেকে মেসেজ পেলাম, যেদিন এলাম তার আগের শনিবারে—“খেলতে চাও এখানে?” এর আগে বরিশাল ও বাংলা টাইগার্সে একসঙ্গে খেলেছি, ফলে ভালোভাবেই চিনি ওকে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাই ঢাকার বিমানে উঠে পড়লাম।’

এর আগে মাত্র একটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলা লিনটট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রথম খেলতে নেমেছেন ১ এপ্রিল, শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বিপক্ষে। নেমেই ম্যাচসেরা। আগের ৫ ম্যাচে জয়শূন্য মোহামেডান বদলে গেছে এরপর, জিতেছে টানা চারটি ম্যাচ। লিনটট ম্যাচসেরা হয়েছেন দুটিতেই।

মোহামেডান সুপার লিগে উঠলে আবার বাংলাদেশে ফিরবেন কি না, লিনটট এখনো নিশ্চিত নন

কৃতিত্বটা অবশ্য একা নিতে চান না। সাকিব, মেহেদী হাসান মিরাজকে পাওয়াও মোহামেডানকে বদলে দিয়েছে বলে মনে করেন। সর্বশেষ কয়েকটি ম্যাচের মতো খেলতে পারলে মোহামেডানের জন্য সুপার লিগে যাওয়াও কঠিন মনে করেন না।

যদিও মোহামেডান সুপার লিগে উঠলে আবার বাংলাদেশে ফিরবেন কি না, লিনটট এখনো নিশ্চিত নন। আপাতত ঈদুল ফিতরের বিরতিতে দেশে ফিরবেন। ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ ব্লাস্ট শুরু হবে পরের মাসে, সেটিতে ফুরফুরে হয়ে নামতে চান। টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট, দ্য হানড্রেড, বিপিএল, সিপিএল, আইএলটি-টোয়েন্টি, টি-টেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ইউএস ওপেন—লিনটট খেলে বেড়ান সবখানে। আধুনিক যুগে লিনটটের গল্পটা নতুন নয়। তবে তাঁর একটু আলাদা গল্পও আছে।

একসময়ের স্কুলশিক্ষক লিনটটের পেশাদার ক্রিকেটে আসা বেশ দেরিতে, প্রথম পেশাদার চুক্তিই সই করেন ২৬ বছর বয়সে। ছোটবেলায় বাঁ হাতে জোরে বল করতে চাইতেন, তবে গতি ছিল না তেমন। লেগ কাটার করতেন তা-ই। সেটি দেখেই এক কোচ পরামর্শ দিয়েছিলেন, লেগ স্পিনার হয়ে যেতে। লিনটট সেটিই হয়ে গেলেন। সুযোগের পাওয়ার অপেক্ষাও বাড়ল তাতে।

কেন, লিনটটই সেটি ব্যাখ্যা করলেন, ‘১৮-১৯ বছর বয়সে আমি যথেষ্ট ভালো ছিলাম না। কারণ, বাঁহাতি রিস্ট স্পিন মোটামুটি একটা মানে যেতেই অনেক সময় লাগে। তবে আমি ধৈর্য ধরেছি। ২৩ বছরের দিকে আমার মনে হয়েছিল, খেলার মতো উপযুক্ত আমি। তখন আবার সবাই ভেবেছে—২৩ বছর বয়স, কখনো খেলেনি, আমরা একে সুযোগ দেব কেন?’

লিনটটের ভিন্ন ধরনের গল্পে করোনাভাইরাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে। সেই অতিমারির সময়ে চাকরি থেকে ছাঁটাই হলেন, ঘরবন্দী লিনটটের হাতে কাজ নেই। এই সময়টাকে মনে হলো নিজের ফিটনেসের দিকে নজর দেওয়ার বড় সুযোগ। সপ্তাহে ৫০ কিলোমিটার দৌড়ান, হাফ ম্যারাথনে অংশ নেন। ফল—২০ কিলোগ্রাম ওজন কমানো। লিনটটের ভাষায়, ‘এটি সবকিছু বদলে দেয়নি অবশ্যই, তবে আমাকে নিয়ে, আমার ওজন নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলেছে এরপর। দেখেই কেউ বলে না—সে অলস, পরিশ্রম করে না। ক্রিকেটের বাইরে ফুলটাইম চাকরি থাকলে এসব করা কঠিন ছিল। কোভিডে সেটি সম্ভব হয়েছিল।’

প্রথম মৌসুম খেলতে নেমেই দ্য হানড্রেডের শিরোপা জিতেছিলেন লিনটট

এরপরই হানড্রেড, টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে দারুণ মৌসুম কাটানো লিনটট সুযোগ পেয়ে গেলেন সাউদার্ন ব্রেভে। তিন মাসের ব্যবধানে স্কুলশিক্ষক লিনটট হয়ে গেলেন দ্য হানড্রেডে চ্যাম্পিয়ন। তাঁর উত্থানটা ঘটল হুট করেই। ওয়ারউইকশায়ার সতীর্থ কার্লোস ব্রাথওয়েট লিনটটের নাম দিলেন, ‘ক্রিকেটের জেমি ভার্ডি।’

কেন এমন নাম, সেটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিনটটের হাসি আর থামে না, ‘কার্লোস এমনিতে আমার ভালো বন্ধু। সে–ই এটি মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। তবে মনে হয়, আমার এত দ্রুত উত্থান বোঝাতে প্রতীকী সেটি। হ্যাঁ, আমি জেমি ভার্ডি না। তবে মিল আছে কিছু ক্ষেত্রে। অবশ্য সে কোটিপতি ফুটবলার, সেদিক থেকে আবার অমিল আছে। সে প্রিমিয়ার লিগও জিতেছে, অর্জনের দিক দিয়ে আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে।’

ভার্ডি হোন বা না, লিনটটের আশা, তাঁর গল্পটা প্রেরণাদায়ী হবে, ‘গল্পটা সুন্দর, কারণ আমার মনে হয় অনেককেই এটি আশা জোগাবে। হয়তো অনেকেই যেভাবে চায়, তত দ্রুত উন্নতি করতে পারে না। ১৮-১৯ বছর বয়সে অনেকেই ভাবে যে তারা যথেষ্ট ভালো না। হতাশ হয়ে অনেকেই খেলা ছেড়ে দেয়। (দেরিতে হলেও) আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। এর পর থেকে ফিরে তাকাইনি। আমরা গল্পটা তাই ভিন্ন ধরনের। তবে তরুণদের জন্য আশাজাগানিয়া—যেকোনো সময় সুযোগ আসতে পারে।’

বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার ক্রিকেটে দুর্লভ এক প্রজাতি। এ সময়েও তাব্রেইজ শামসি, জহির খানদের মতো কজন ছাড়া তেমন কেউ নেই। লিনটট অবশ্য সেটি অবলম্বন করেই এগোতে চান, ‘দিনের শেষে ফিঙ্গার স্পিন করাটা তো সহজ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে রিস্ট স্পিনের চাহিদা বাড়ছে। আপনি স্বতন্ত্র, অনন্য। এটি আপনাকে আলাদা করে তোলে। এ কারণেই আমি এটি ধরে রেখেছি। রিস্ট স্পিনার হলে দল পাওয়াটাও সহজ হয় কিছুটা।’

লিনটট বিপিএলে ফিরতে চান আবারও

লিনটট সাধারণ লেগ স্পিনের মতো গুগলিও করেন অনেক। আর নিজেকে আক্রমণাত্মক ক্রিকেটার ভাবতে পছন্দ করেন, ‘আমার মনে হয় দলে আমার ভূমিকা আক্রমণ করা, উইকেট নেওয়া। মাঝে মাঝে অন্যদের চেয়ে বেশি রান দিয়ে ফেলি হয়তো। তবে রিস্ট স্পিনার মানে আপনি দলে আছেন উইকেট নেওয়ার জন্য। আমি সেটিই উপভোগ করি।’

আক্রমণাত্মক মানসিকতার কারণে বেন স্টোকস-ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যুগের ইংল্যান্ডের টেস্ট খেলাও খুব উপভোগ করেন। নিজে এখন পর্যন্ত লাল বলে স্বীকৃত ম্যাচ খেলেছেন একটিই। ২৯ বছর বয়সে এখনো কি জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেন? লিনটটের সোজাসাপটা উত্তর, ‘সবারই স্বপ্ন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা। যদি সে স্বপ্ন না-ই থাকে, তাহলে ক্রিকেট খেলার মানে কী।’

তবে বাস্তবতাও তাঁর জানা, ‘তবে ইংল্যান্ডে অনেক রিস্ট স্পিনার আছে। আদিল রশিদ অনেক দিন থেকেই বেশ ভালো করছে। রেহান আহমেদকে আনা হয়েছে, দারুণ এক প্রতিভা। তবে এসব নিয়ে ভাবি না। আপাতত আমার মনোযোগ নিজেকে ঘিরেই। যে সুযোগই আসুক না কেন—ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, আইএলটি-টোয়েন্টি, যদি বিপিএলে আবার সুযোগ পাই, কাজে লাগাতে চাই। এরপর ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ব্লাস্ট আছে, হানড্রেড আছে। সেগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাকিগুলো এমনি এমনি হয়ে যাবে।’

বিপিএলের সর্বশেষ মৌসুমে খেলেননি, একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন লিগ আইএলটি-টোয়েন্টি বেছে নিয়েছেন বলে। একটির বেশি ম্যাচ খেলার অবশ্য সুযোগ পাননি। সর্বশেষ বিপিএল চাপে পড়েছিল আইএলটি-টোয়েন্টি ও দক্ষিণ আফ্রিকার এসএটোয়েন্টির সঙ্গে সাংঘর্ষিক সূচির কারণে। শীর্ষ মানের বিদেশি ক্রিকেটারদের তাই টানা পায়নি বিপিএল।

সামনে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিপিএলকে পিছু হটতে হবে বলেও মনে করেন লিনটট, ‘আমি বুঝি না, টুর্নামেন্টের আয়োজকেরা কেন একসঙ্গে আয়োজন করছে লিগগুলো। এসএ২০ আর আইএলটি-টোয়েন্টি অনেক বড়, তারা জায়গা ছেড়ে দেবে না। যদি বিপিএল চায় সেরা খেলোয়াড়েরা বাংলাদেশে এসে খেলুক, তাহলে বছরের এমন একটা সময় বের করতে হবে। সামনের বছরও আবার জানুয়ারিতেই হবে। আবার সূচির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। টুর্নামেন্টগুলো বিভিন্ন সময়ে হলে ভালো হতো।’

এসএ২০ আর আইএলটি-টোয়েন্টি অনেক বড়, তারা জায়গা ছেড়ে দেবে না। যদি বিপিএল চায় সেরা খেলোয়াড়েরা বাংলাদেশে এসে খেলুক, তাহলে বছরের এমন একটা সময় বের করতে হবে।
জেক লিনটট

তবে ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে’ এর একটা ভালো দিকও দেখেন, ‘আবার এর কারণে হয়তো অনেকে সুযোগ পাচ্ছে, যারা অন্য সময়ে পেত না। আমার জন্য এটি ভালোই। এসএটোয়েন্টি বা আইএলটি-টোয়েন্টি যদি অন্য স্পিনারকে নিয়ে নেয়, বাংলাদেশে আমি ভালো একটা চুক্তিতে আসতে পারব। ইতিবাচক, নেতিবাচক দুটিই আছে তাই এসবের। তবে আমার মনে হয় আয়োজকদের সেরা উইন্ডোটা বের করা উচিত।’

লিনটটের যা নাম, তা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের প্রতি একটু সহানুভূতিও বোধ করেন, ‘এমন যদি হতো, পঞ্জিকাবর্ষের একটা উইন্ডোতে আপনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলছেন, আরেকটিতে ঘরোয়া খেলছেন, তাহলে ভালো লাগত। কারণ, এখন খেলোয়াড়দের ওপর বাড়তি একটা চাপ দেওয়া হচ্ছে। তারা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অনেক আয় করছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলারও চাপ আছে। এটা স্বাস্থ্যকর নয়। এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই সবার ওপরে। দেশের হয়ে খেলাটাই সবচেয়ে বড়। আমি চাই না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মূল্য হারিয়ে ফেলুক।’

সাকিব এর আগে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে এনেছিলেন মঈন আলীকে। তাঁর সঙ্গে সাকিবের বন্ধুত্ব মূলত উস্টারশায়ারে খেলতে গিয়েই। গত মৌসুমে উস্টারের সঙ্গে ১৫ বছরের সম্পর্ক শেষ করে ওয়ারউইকশায়ারে গেছেন মঈন, লিনটট সেখানে পেয়েছিলেন পেশাদার কাউন্টি ক্রিকেটের স্বাদ। মঈন যে বাংলাদেশে এসেছিলেন, সেটিও জানেন লিনটট। বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে, সেটি তো অবশ্যই।

বাংলাদেশে তাই ফিরতে চান আবারও। আর নিজের স্বপ্ন নিয়ে বলেন, ‘ক্যারিয়ারের শেষে গিয়ে কোনো আক্ষেপ করতে চাই না। আমার বয়স ২৯, এখন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলতে আসার হয়তো দরকার ছিল না। তবে আমি আরও উন্নতি করতে চাই। সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।’

সে সুযোগের পরের ধাপ মোহামেডানের পরের ম্যাচ, শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে। সে ম্যাচের জন্য শুভকামনা জানানোর আগেই লিনটট উলটো শুভকামনা জানিয়ে বলে উঠলেন, ‘আশা করি, যাওয়ার পথে এতটা ট্রাফিক থাকবে না!’

ঢাকার রাস্তায় শুভকামনার প্রয়োজনও কম নয়, সেটিও লিনটটের জানা হয়ে গেছে।