‘এটিই আমাদের কাছে বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো।’
২০২১ সালে আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার আগে বলেছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। চেতেশ্বর পূজারা, অজিঙ্কা রাহানের মতো অশ্বিনও তখন শুধু ভারতের হয়ে টেস্টই খেলেন। অশ্বিন এরপর সীমিত ওভারের দলে ফিরেছেন, রাহানে তো টেস্ট দলে ফিরলেন দুর্দান্ত এক আইপিএল কাটানোর পর। গল্পটা শুধু পূজারার জন্যই বদলায়নি।
এপ্রিল থেকেই সাসেক্সের হয়ে খেলছিলেন পূজারা, এবারও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্যাটিংয়ে এখন পর্যন্ত মৌসুমটা কেটেছে দারুণ—৮ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি ও ১ ফিফটি। পূজারা যখন ইংল্যান্ডে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ডিভিশন টু-তে খেলছিলেন, ভারতে তখন আইপিএলের ‘ভরা মৌসুম’। ২০১৪ সালে সর্বশেষ আইপিএলে খেলা পূজারা গত নিলামে নামই তোলেননি।
আজ থেকে ওভালে শুরু টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে ভারত দলের ১৫ জনের মধ্যে পূজারা ছাড়া বাকি ১৪ জনই প্রায় দুই মাস দীর্ঘ আইপিএলের অংশ ছিলেন। প্রায় উল্টো চিত্র অস্ট্রেলিয়ার। তাদের মাত্র দুজন—ডেভিড ওয়ার্নার ও ক্যামেরন গ্রিন খেলেছেন এবারের আইপিএলে।
অধিনায়ক প্যাট কামিন্স আগেই আইপিএল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। স্টিভ স্মিথ, মাইকেল নেসার, মার্কাস হ্যারিসরা খেলেছেন কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে, স্মিথ তো সাসেক্সে পূজারার সতীর্থও ছিলেন। টেস্ট শ্রেষ্ঠত্বের তুলনামূলক নতুন এ লড়াইয়ে দুই দল নামছে তাই কিছুটা বিপরীতমুখী বিন্দুতে দাঁড়িয়েই। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের দাপটের এই যুগে, ঠাসা সূচিতে এ ফাইনাল আসলে টেস্ট ক্রিকেটকে কতটা নতুন জীবনীশক্তি দেবে?
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় এই চক্র শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের আগস্টে। অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল নিশ্চিত করেছিল আগেভাগেই, গতবার যারা দৌড় থেকে ছিটকে গিয়েছিল মূলত স্লো ওভাররেটের পেনাল্টির কারণে। ভারতকে অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল একটু বেশি। প্রায় দুই বছর ধরে চলা লিগটির শিরোপার নিষ্পত্তি হবে একটি ম্যাচ দিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারের চাওয়া, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল যাতে অন্তত তিন ম্যাচের একটি সিরিজ হয়। তবে ক্রিকেটের এখনকার যে সূচি ও কাঠামো, তাতে এমন তিনটি টেস্ট কোন নিরপেক্ষ দেশ আয়োজন করতে চাইবে—তা একটি বড় প্রশ্নই বটে। আইসিসির জেনারেল ম্যানেজার ওয়াসিম খান জানিয়েছেন, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কাঠামো নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও সদস্যদেশগুলো এখন পর্যন্ত এক ম্যাচের ফাইনালেই আগ্রহী।
আইসিসি এবারও ফাইনালের জন্য বেছে নিয়েছে ইংল্যান্ডকে। ওয়ানডে বিশ্বকাপের শুরুর দুটি আসরই হয়েছিল দেশটিতে, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম দুটি ফাইনালও সেখানেই। টেস্ট ক্রিকেটের ‘চাহিদা’ এখনো দেশটিতে বেশ ভালোই, দুটি নিরপেক্ষ দেশের লড়াইয়েও তাই আগ্রহ থাকারই কথা।
আবার ভারত আছে বলে তাদের সমর্থকদেরও ভিড় করার কথা লন্ডনের এ মাঠে। তবে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনাটা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বাইরে চিত্রটা শঙ্কা জাগানিয়াও বটে। কামিন্স বোর্ডের সঙ্গে কেন্দ্রীয় চুক্তির সৌজন্যে সহজেই আইপিএলকে না বলতে পারেন, অথচ ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেটের জন্য নিজেকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার স্বেচ্ছায় হুমকির মুখে ফেলে দেন নিউজিল্যান্ড পেসার ট্রেন্ট বোল্ট।
সম্প্রতি এক পডকাস্টে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড গোল্ড বলেছেন, আর্থিক লাভের কারণে নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেশগুলো এখন টেস্টের চেয়ে সীমিত ওভারের দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আয়োজনেই নাকি বেশি আগ্রহী। ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগগুলোর উত্থান যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কাঠামোর দিকেই চোখ রাঙাচ্ছে, উত্তাপটা লাগছে গিয়ে দীর্ঘ সংস্করণের ক্রিকেটেও। দিন শেষে ক্রিকেট বা এমন খেলা একটা ‘পণ্য’ই, যাতে চাহিদা ও জোগানের হিসাব থাকে। চাহিদাই যদি না থাকে, তাহলে জোগান আসবে কোথা থেকে!
টেস্টের এই ফাইনাল ক্রিকেটের বৈশ্বিক সম্প্রসারণে কতটা ভূমিকা রাখবে, সে প্রশ্ন অবশ্য আপাতত এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। ভারত বা উপমহাদেশের বড় একটা জনগোষ্ঠী ক্রিকেটমুখী বলে টেলিভিশন দর্শক বা এমন কিছুতে ক্রিকেট হয়তো অন্য খেলার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তবে খেলাটির প্রশাসকেরাই এর সম্প্রসারণ কতটা চান—তা নিয়ে বড় একটা প্রশ্নই আছে।
তার ওপর আছে আইসিসির ‘অধারাবাহিকতা’, কখন কোন ফরম্যাটে কোন বিশ্বকাপ হবে, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আদতে হবে কি না—সেটি নিয়ে তারা নিজেরাই যেন ধন্দে পড়ে যায় বারবার। ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটও প্রবল হয়ে ওঠে মাঝেমধ্যেই। তবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য আপাতত স্বস্তিই আছে, পরের আট বছরের চক্রের জন্য এতে অংশ নিতে রাজি আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলো।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ইংল্যান্ডে, প্রসঙ্গক্রমে চলে আসছে ‘বাজবল’-ও। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের মতে, ক্রিকেট সমর্থকদের ফাইনালে একটা ‘ফল’ দেখা প্রাপ্য। সেটি করতে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও বেন স্টোকসের ইংল্যান্ডের পথ অনুসরণ করে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলা উচিত অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের। স্টোকস বরাবরই বলে এসেছেন, টেস্ট ক্রিকেটকেও মানুষের কাছে বিনোদনদায়ী করে তুলতে চায় তাঁর দল। তবে দায়িত্বটা শুধু ইংল্যান্ড নয়, অন্যান্য দলকেও তো নিতে হবে।
অবশ্য ইংল্যান্ডের ওই রেসিপি ছাড়াও ফাইনালে ফল আসতেই পারে, তাতেও স্বাভাবিকভাবেই মিলতে পারে রোমাঞ্চ। বিরাট কোহলি বা শুবমান গিল, প্যাট কামিন্স বা স্টিভেন স্মিথরা ক্রিকেটের অন্যতম পুরোনো এক ভেন্যুতে মুখোমুখি ডিউক বলের লড়াইয়ে—রোমাঞ্চের রসদ তো কম নেই!
২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকেই বৈশ্বিক ট্রফির একটা আক্ষেপ থেকে গেছে ভারতের, গতবারের ফাইনালেও নিউজিল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছে ক্রিকেট-বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিদের। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার কাছে এ শিরোপাটি চক্র পূরণের উপলক্ষ—এখন শুধু এ সংস্করণের বৈশ্বিক ট্রফিটা নেই তাদের কাছে।
অস্ট্রেলিয়া দলের বেশ কয়েকজন অবশ্য কয়েক মাস পরই ভারতে হতে যাওয়া ‘আসল’ বিশ্বকাপ—ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে এরপর থাকবেন নাথান লায়নের মতো কেউ। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা অফ স্পিনার সীমিত ওভারে নিজের সর্বশেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে, সেমিফাইনালে হেরে যেবার শেষ হয়ে যায় তাদের বিশ্বকাপ–ভাগ্য। ‘এটিই আমার কাছে বিশ্বকাপ ফাইনাল’, লায়ন সরাসরিই বলেন তাই।
লায়নের এই ‘বিশ্বকাপ ফাইনাল’টা ফাইনালের মতো হলে নতুন আশা পাবে তো টেস্ট ক্রিকেটও।