‘সালাহ উদ্দীন’স মাস্টার ক্লাস’ বইটা হাতে পেয়ে আবেগাক্রান্ত হয়েছি এ জন্য নয় যে, বইটি যাঁদের নামে উৎসর্গিত, আমি তাঁদের একজন। আমার আবেগাক্রান্ত হওয়া বরং এ কারণে যে, বইটির রচয়িতা আমার একসময়ের ছাত্র এবং পরে সহকর্মী মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন। যাকে আমি দীর্ঘ সময় ধরে জানি, যাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এই বই লেখার পেছনে ওর যে সৎ উদ্দেশ্য এবং ক্রিকেটকে ঘিরে ওর যে আবেগ, তা আমি অনুভব করতে পারি।
সালাহ উদ্দীনকে আমি প্রথম দেখেছি বিকেএসপিতে প্রায় ৩৫ বছর আগে। কিশোর সালাহ উদ্দীন তখন নিজেকে জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার সাধনায় মগ্ন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইনজুরির কারণে সালাহ উদ্দীনের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক খেলা থেকে। কিন্তু খেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেও ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি সালাহ উদ্দীন। তার আবির্ভাব ঘটে একজন কোচ হিসেবে। নিজের অপূর্ণ স্বপ্নগুলোকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ সেই শুরু। এই কাজে সালাহ উদ্দীন কতটা সফল, তা আমরা সবাই জানি। আজ সে দেশসেরা কোচ। কিন্তু নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তোলার জন্য তার যে প্রয়াস, সেটি হয়তো আমাদের সবারই অজানা। ‘সালাহ উদ্দীন’স মাস্টার ক্লাস’ বইটায় চোখ বোলালে আমরা হয়তো তার জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারব, বুঝতে পারব কেন সে সবার কাছে অনুকরণীয়।
বইটির শুরুতেই ব্যাটিং–বোলিং বাদ দিয়ে ক্রিকেট মনস্তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাই বলে দেয় যে এটি অন্য যেকোনো প্রথাগত ক্রিকেট কোচিং বইয়ের থেকে ভিন্ন। কেবল টেকনিকই নয়, তার পাশাপাশি মেন্টাল স্কিল এবং ট্যাকটিক্যাল জ্ঞানও যে সফলতার জন্য অপরিহার্য, এই সত্যটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বারবার উঠে এসেছে বইটিতে। একজন ক্রিকেটারের সঠিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি কেমন, সে ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে বা তার সমাধানই–বা কী, তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা আছে। সবার জন্য যে একই সমাধান নয়, সে ব্যাপারেও বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে। খেলাটা কীভাবে শিখতে হবে, শুধু তার মধ্যেই বইটির বিষয়বস্তু নির্বাচনে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি সালাহ উদ্দীন, বরং কীভাবে পারফর্ম করতে হবে, সেটিই বইয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এ কারণেই বইটি ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট সবার জন্য একটি রেফারেন্স বুক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে।
ক্রিকেটে বোলিংয়ের তুলনায় ব্যাটিং অনেক বেশি চ্যলেঞ্জিং। কারণ, একজন বোলারের আগে থেকেই করণীয় সম্পর্কে জানা থাকলেও ব্যাটসম্যানের সেই সুযোগ থাকে না। তাকে শেষ মুহূর্তে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই ব্যাটিংকে ‘ওপেন’ এবং বোলিংকে ‘ক্লোজড’ স্কিলের অন্তর্গত ধরা হয়। কোচিং মেথড প্রয়োগের ক্ষেত্রে একজন কোচের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতেই হবে। সালাহ উদ্দীন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বইটিতে এই বিষয়গুলো তুলে এনেছে। এর মধ্য দিয়ে একজন কোচের পক্ষে সহজেই স্কিল ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়ের যোগ্যতা অনুযায়ী আদর্শ মেথডটি নির্ধারণ করা সহজ হবে।
বায়োমেকানিকস নিয়ে আলোচনা অনেকের কাছেই কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে। মৌলিক আলোচনার পাশাপাশি বিষয়টিকে সহজভাবে বুঝিয়ে বলার একটা চেষ্টা বইটিতে আছে। আমাদের প্রত্যেকেরই শারীরিক গঠনে ভিন্নতা আছে। তাই টেকনিক ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে এই স্বকীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে চাইলে বায়োমেকানিকস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকতেই হবে। তা না হলে অনুকরণ অথবা একই জিনিস সবার ওপর প্রয়োগ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এটি কাঙ্ক্ষিত নয়। আশা করব, এই বইটিকে একটি রেফারেন্স হিসেবে নিয়ে এ বিষয়ে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করবেন আমাদের স্থানীয় কোচরা।
আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে সব বিষয়েই কোচের ওপর নির্ভর করার প্রবণতা রয়েছে। এটি ছোট থেকে বড় সবার মধ্যেই। এই বই নিশ্চিতভাবেই ওদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। ওরা অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে এবং নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে। কাঙ্ক্ষিত মানসিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য এটি জরুরি। পাশাপাশি বিভিন্ন ফরম্যাটে নিজেদের কীভাবে মানিয়ে নেবে, তা বুঝতেও বইটি সহায়ক হবে।
ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট সবাই বিশেষ করে খেলোয়াড় ও প্রশিক্ষকেরা যেন খুঁটিনাটি প্রতিটি ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন, সেই জন্য বিষয়ের গভীরে যেতে কার্পণ্য করেনি সালাহ উদ্দীন। এটি অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য, তবে এর প্রয়োজন ছিল। আমাদের কোচিং সংস্কৃতিতে খেলোয়াড়দের ব্যর্থতার জন্য কেবল টেকনিককে দায়ী করার যে সহজাত প্রবণতা রয়েছে, সেটি যে ঠিক নয়, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখানে উঠে এসেছে। পাশাপাশি একজন খেলোয়াড় গড়ে তোলার পূর্বশর্তগুলোর সমন্বয় কীভাবে করতে হবে, সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট ধারণ দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। এ ধরনের বিস্তৃত আলোচনা সহজ নয়। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সবার সঙ্গে নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমলব্ধ জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার উদারতার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে, পাশাপাশি বিষয়বস্তু সম্পর্কে সালাহ উদ্দীনের জ্ঞানের গভীরতার ব্যাপারটিও ফুটে উঠেছে।
কোনো খেলাকে ঘিরে বাংলায় লেখা এমন বই খুব একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সালাহ উদ্দীনকে ধন্যবাদ আমাদের এই বই উপহার দেওয়ার জন্য। ওর মেধাকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলাম না, এই দুঃখ আছে। তবে আশার কথা, আমাদের এই অবহেলা ওকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। আশা করি, ভবিষ্যতেও সে নিজের মতো করেই ক্রিকেটের উন্নয়নে এভাবে অবদান রেখে যাবে। প্রিয় সালাহ উদ্দীনের জন্য অনেক শুভকামনা।