ঘোষণাটা আসার পর মনে হয়েছিল, এটাই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত। গত বছরের ২২ জুন টেস্ট দলের নেতৃত্বে সাকিব আল হাসানের প্রত্যাবর্তন হলো ডেপুটি হিসেবে লিটন দাসকে নিয়ে। সাকিবের অধিনায়ক হওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তো ছিলই না, নেতৃত্বের জুটিতে তাঁর সঙ্গে লিটনের আবির্ভাবকেও মনে হয়েছিল সময়ের দাবি। কিন্তু যাঁকে ভবিষ্যতের নেতা ভাবা হলো, সেই লিটনই কিনা সাকিবের অনুপস্থিতিতে টেস্ট দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রথম সুযোগে মৃদু অনীহা প্রকাশ করে ফেললেন!
যদিও সর্বশেষ খবর হলো, লিটনের অনীহা দূর হয়েছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে আসন্ন সিরিজের একমাত্র টেস্টে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ দলকে। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন গতকাল এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন, অধিনায়কত্বের বাড়তি দায়িত্বের সঙ্গে নিজের ব্যাটিংয়ের যে কাল্পনিক সংঘাতের শঙ্কায় লিটন ছিলেন, সেটি তাঁর মন থেকে উবে গেছে। আগামী ১৪ জুন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সাদা পোশাকে লিটনই নামবেন টস করতে। তারপরও প্রশ্নটা থেকে যায়—লিটন কেন ক্ষণিকের জন্য হলেও তাঁর বিকল্প ভাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি করলেন? ‘সুসংবাদ’কে কেন তিনি ‘দুঃসংবাদ’ ভেবে বসলেন!
আয়ারল্যান্ড সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে পাওয়া আঙুলের চোট সাকিবকে ছয় সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশ্যই বাংলাদেশ দলের জন্য এটা বড় দুঃসংবাদ। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে লিটনের তো এই দুঃসংবাদকে ‘সুসংবাদ’ হিসেবেই নেওয়া উচিত ছিল! ‘সুসংবাদ’ এই অর্থে যে সহ–অধিনায়কের পার্শ্বচরিত্রের খোলস থেকে বেরিয়ে টেস্টে এই প্রথম তিনি সুযোগ পেতে যাচ্ছেন অধিনায়কত্বের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আসার। নিজের নেতৃত্বগুণ প্রকাশের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ এটা তাঁর জন্য।
২০১৯ সালের অক্টোবরে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় সাকিবের নির্বাসনের পর থেকে বাংলাদেশ দলে সহ–অধিনায়ক রাখার চর্চাটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল। মুমিনুল হক টেস্ট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কোনো ডেপুটি ছাড়াই। ওয়ানডে আর টি–টোয়েন্টি দলে তো এখনো সহ–অধিনায়ক নেই, যেটা সর্বশেষ আয়ারল্যান্ড সিরিজে জন্ম দিয়েছিল হাস্যকর এক পরিস্থিতির। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে কিছু সময়ের জন্য মাঠ ছেড়েছিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ওই সময় বোলিং করতে এলে সাকিবের কাছে আম্পায়ার জানতে চান, কোনো কারণে রিভিউ নেওয়ার প্রয়োজন হলে কে নেবেন? অধিনায়ক তো মাঠে নেই। সাকিবকে তখন মাঠেই মুশফিকুর রহিমকে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, ‘ভাইস ক্যাপ্টেন কে?’ মুশফিক বলে দিলেন, লিটন। সাকিবও সেটাই জানিয়েছিলেন আম্পায়ারকে।
সে ম্যাচের কিছু সময় ওই রকম অপ্রত্যাশিতভাবে এবং এর আগে গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে তামিমের অনুপস্থিতিতে ঘোষিত অধিনায়ক হিসেবেই পুরো ওয়ানডে সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লিটন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২–১–এ জিতেছিল সেই সিরিজ। আর এবার তো লিটনকে ডেকে এনে দায়িত্ব দেওয়ারও কিছু নেই। অধিনায়ক কোনো কারণে খেলতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সহ–অধিনায়কই হবেন অধিনায়ক। সাকিব সিরিজের বাইরে চলে যাওয়ার পরই মানসিকভাবে সেই প্রস্তুতি লিটনের নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ, এ রকম পরিস্থিতিতে তিনি দায়িত্ব নিতে পারবেন, এমন আস্থা থেকেই তাঁকে সহ–অধিনায়ক করা। আর সহ–অধিনায়কের কাজ শুধু অধিনায়ক মাঝ ম্যাচে জরুরি কাজে ড্রেসিংরুমে গেলে মাঠ সামলানো নয়। মাঠ ও মাঠের বাইরে তাঁর আরও অনেক কাজ থাকে। সবচেয়ে বড় কাজ অধিনায়ক না থাকলেও দলের মধ্যে সেই অভাবটা অনুভূত হতে না দেওয়া।
নেতৃত্বে নতুন লিটনের কাছে শুরুতেই বড় কোনো প্রত্যাশা না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁর মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতার গুণাগুণ আবিষ্কৃত হয়েছে বলেই তিনি এই দায়িত্বে। মাঠে ম্যাচের পরিস্থিতি ভালো বুঝতে পারা, সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে অধিনায়ককে প্রয়োজনের সময় সঠিক পরামর্শ দেওয়া, ড্রেসিংরুমে সবাক হয়ে ওঠা এবং এসবের সঙ্গে ব্যাট হাতে নিজের পারফরম্যান্সটাও ধারাবাহিক রাখতে পারা—এই সবকিছু যোগ করেই বিসিবির মনে হয়েছে, নেতৃত্বের সিঁড়িতে লিটনকে উঠতে দেওয়া যায়। টেস্ট অধিনায়ক সাকিবকেও যদি জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে নেতা হওয়ার ঝলকানি সবচেয়ে বেশি দেখেন কার মধ্যে, সাকিব লিটনের নামটাই বলবেন সবার আগে।
অথচ ‘সুসংবাদ’কে ‘দুঃসংবাদ’ ভেবে সেই লিটনই উসকে দিলেন প্রশ্নটা—নেতৃত্বের সিঁড়িতে পা রাখতে আসলেই কি প্রস্তুত তিনি?