‘চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি। যদিও আমার বোলিং এখনো অতিমাত্রায় জঘন্য। খুবই বাজে!’
বোলিংয়ে বেশ খাটতে দেখা গেল, এমন কথা মনে করিয়ে দেওয়ার পর সরল স্বীকারোক্তি হ্যারি টেক্টরের। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ওয়ানডে শুরুর আগের দিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আউটার গ্রাউন্ডের অনুশীলনে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়েও বেশ মনোযোগী টেক্টর। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বোলিং করছিলেন প্রায় সব কটি নেটেই।
নিজের বোলিং নিয়ে টেক্টর খুব একটা বাড়িয়ে বলেননি। অন্তত প্রথম ওয়ানডেতে সাকিব আল হাসানের হাতে হেনস্তা হওয়ার পর তাঁর নিজেরও অমনই মনে হওয়ার কথা। প্রথম ৪ ওভারে ২৩ রান দিয়েছিলেন, বাঁহাতি সাকিব ও ডানহাতি তাওহিদ হৃদয়ের সামনে ম্যাচআপে অফ স্পিনার টেক্টরকেই উপযুক্ত মনে হচ্ছিল আইরিশ অধিনায়ক অ্যান্ডি বলবার্নির। পঞ্চম ওভার করতে এসে পড়লেন সাকিবের কবলে। এক, দুই, তিন…গুণে গুণে সাকিব মারলেন পাঁচটি চার। টেক্টরকে আর বোলিংয়েই আনলেন না বলবার্নি।
বোলিংয়ের মতো ব্যাটিংয়েও দিনটা ভুলে যাওয়ার মতোই গেছে টেক্টরের। যদিও সাম্প্রতিক ফর্ম ছিল দুর্দান্ত। বাংলাদেশে আসার আগে টেক্টরের আগের ৮টি ওয়ানডে ইনিংস ছিল এমন—৫৩, ৫৪*, ৫২, ১১৩, ৪, ১০৮, ১০১* ও ৭৫!
গত জানুয়ারিতে দ্রুততম আইরিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ১ হাজার রানের রেকর্ড গড়েছেন। সিলেটে প্রথম ওয়ানডেতে ৩ রানে আউট হওয়ার পরও গড় ৫১.১৪। ৫০-এর ওপর গড়ে কমপক্ষে ১ হাজার রান করেছেন, ওয়ানডেতে এমন রেকর্ডই আছে টেক্টর ছাড়া মাত্র ১৩ জনের।
জাতীয় দলের হয়ে বাংলাদেশ সফরে এই প্রথমবার, সিলেটেও খেললেন প্রথমবার। তবে বাংলাদেশে এসেছেন এর আগেও—২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে, পরে এসেছিলেন আয়ারল্যান্ডের ‘এ’ দল—উলভসের সঙ্গে।
প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা টেক্টরের ভালোই মনে আছে, ‘২০১৬ তো দারুণ লেগেছিল। ১৫ বা ১৬ বছর বয়স ছিল আমার। প্রথমবার বিশ্বকাপের মতো ব্যাপার। প্রথমবার টিভিতে খেলা দেখানো হচ্ছে—কুল! নিজের কাছে তেমন প্রত্যাশাও ছিল না। তেমন কিছু করিওনি। “এ” দলের হয়ে সফর দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। আমার ও দলের সে সময় দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল এমন কন্ডিশনে খেলার। আশা করি, এবারও ভালোই যাবে।’
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের অধিনায়কত্বে ছিলেন হ্যারির বড় ভাই জ্যাক টেক্টর। পরের দুটি বিশ্বকাপেও অধিনায়কত্ব থেকেছে টেক্টর পরিবারেই। দুই বছর পর, ২০১৮ সালে পরের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেন হ্যারি।
২০২২ সালে দলটির অধিনায়ক ছিলেন জ্যাক ও হ্যারির ভাই টিম! হ্যারি টেক্টরের কাছে, এটি ‘বিশেষ একটি ব্যাপার, দারুণ!’ শুধু তিন ভাই নন, তাঁদের বোন অ্যালিসও অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলছেন। হ্যারির মতে, ‘সবচেয়ে ভালো খেলে সে-ই।’
একসময় আয়ারল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল ক্রিকেট খেলা, ফলে ক্রিকেট-চর্চা আবদ্ধ ছিল পারিবারিক আবহে, হাতে গোনা কয়েকটি ক্লাবে। টেক্টরের বাবাও ক্রিকেটপাগল, ‘আমার বাবা ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন, তবে বাজে খেলতেন। ডাবলিনে আমাদের ক্লাবের নাম ওয়াইএমসিএ। তিনিও সেখানে খেলতেন, আমার পুরো পরিবারই সেখানে খেলে। পুরোই ক্রিকেটপাগল পরিবার বলতে পারেন।’
শুধু ক্রিকেটপাগল না বলে খেলাপাগলও বলা যায় আসলে। হ্যারি টেক্টরের দাদা বিল টেক্টরও যে খেলতেন আয়ারল্যান্ড রাগবি দলে!
টেক্টরদের খাবার টেবিলে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো প্রসঙ্গও তেমন থাকে না, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শুধুই ক্রিকেট আর ক্রিকেট। মা কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে চান। কিন্তু ক্রিকেট ফিরে ফিরে আসে।’
টেক্টরের ভাইবোনই শুধু নয়, তাঁর প্রেমিকাও ক্রিকেটার। মনে করিয়ে দেওয়ায় টেক্টর বললেন, ‘হ্যাঁ, গ্যাবি আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলে খেলে।’ এরপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘ও আমার চেয়ে অনেক অনেক ভালো!’
গ্যাবি লুইসের পরিচয় বোধ হয় টেক্টরের দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। হাসতে হাসতে বললেও প্রশংসাটাও টেক্টর বাড়িয়ে করেননি। ২০১৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল লুইসের, যেটি আয়ারল্যান্ডের রেকর্ড।
২০২২ সালে তিন ম্যাচে ওয়ানডেতে আয়ারল্যান্ডকে নেতৃত্বও দিয়েছেন লুইস, সেটিও মাত্র ২১ বছর ৭৬ দিন বয়সে। মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসেই লুইসের চেয়ে কম বয়সী অধিনায়ক আছেন মাত্র পাঁচজন।
টেক্টরের মুখে লুইসের প্রশংসা তাই ফুরোয় না, ‘সে দারুণ করছে। সে একই সঙ্গে খেলে, পড়াশোনা করে। কলেজে খুবই কঠিন কঠিন কোর্স নেয়। কীভাবে কীভাবে যেন সব করে ফেলে। আয়ারল্যান্ডের হয়েও দারুণ খেলে। সে দুর্দান্ত, সবই করতে পারে!’
তবে কি হ্যারি টেক্টর ও গ্যাবি লুইস হতে যাচ্ছেন ক্রিকেটের পরবর্তী মিচেল স্টার্ক ও অ্যালিসা হিলি? প্রশ্নটা শুনে টেক্টর লজ্জা পেয়ে চোখ-মুখের ওপর হাত এনে ‘ওহ্, নো, নো’ বলতে লাগলেন, একটু যেন লালও হয়ে গেলেন, ‘একেবারেই না। জানি না, কীভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেব! খুবই কঠিন প্রশ্ন।’
এমনিতে টেক্টর ও লুইসের বাবা বন্ধু, ফলে প্রেমিকার সঙ্গে টেক্টরের পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। কয়েক বছর আগে টুইটারে ঘুরে বেড়ানো একটা ছবিতেও দেখা যায় ছোট্ট টেক্টর ও লুইসকে, যেখানে তাঁরা এউইন মরগানের সঙ্গে একই ফ্রেমে।
সেই ছবি বের করে দেখালে টেক্টর বলা শুরু করলেন, ‘ইংল্যান্ড ২০১০ সালে বোধ হয় ক্লনটার্ফে (ডাবলিনের মাঠ) খেলতে এসেছিল। মরগানও এসেছিল। ক্যাপ–ব্যাটে সাইন নিয়েছিলাম। আমার জন্য বিশেষ একটা দিন। আমিই ছবিটা দেখিনি, কিছুদিন আগে টুইটারে এসেছিল।’ টেক্টর এরপর ছবির মানুষগুলোকে চেনাতে শুরু করেন, ‘এটা গ্যাবি, ওপাশে গ্যাবির বোন, পেছনে আমি, সামনে আমার ছোট ভাই টিম…’
একসময় টেস্ট খেলার স্বপ্ন নিয়ে দল বদলে আয়ারল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন মরগান। টেক্টরের আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগেই আয়ারল্যান্ড টেস্ট মর্যাদা পেয়ে গেছে, খেলেও ফেলেছে। তবে টেক্টরের অভিষেকের পর থেকে আর টেস্ট খেলেনি আইরিশরা।
বাংলাদেশ সফরে এবার একটি টেস্ট আছে, টেক্টর এখন সেই স্বপ্নপূরণের অপেক্ষায়, ‘অসাধারণ একটা ব্যাপার হবে, দারুণ রোমাঞ্চিত আমি। স্বপ্নপূরণের মতো ব্যাপার। আশা করি খেলব, যতটা পারি রান করব। দারুণ এক অভিজ্ঞতা হবে।’
শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষে নয়, এ বছর আয়ারল্যান্ড খেলবে বেশ কয়েকটি টেস্ট। টেস্ট খেলার স্বপ্নের কথা নাহয় বললেন, এমনিতে ক্রিকেট নিয়ে টেক্টর কী স্বপ্ন দেখেন? ‘অনেক কিছু। তবে বলব না। আমার অনেক স্বপ্ন আছে।’
ব্যক্তিগত স্বপ্নের কথা বলতে না চাইলেও আইরিশ ক্রিকেটকে নিয়ে স্বপ্নের কথা বললেন ঠিকই, ‘আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ১০-১৫ বছরের মধ্যে আয়ারল্যান্ডও এখনকার বাংলাদেশের মতো হবে। যখন ধারাবাহিকভাবে আমরা বিশ্বের শীর্ষ দলগুলোকে হারাব। আমি আইরিশ ক্রিকেটকে সেখানেই দেখতে চাই। আশা করি, আমরা সেখানে যেতে ঠিকঠাক সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারব।’
আইসিসির পূর্ণ সদস্য মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে অবশ্য আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের কাঠামো বদলে গেছে। আগে স্থানীয় ক্রিকেটার হিসেবে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্লাবগুলোতে খেলার সুযোগ পেতেন আইরিশ ক্রিকেটাররা, তবে এখন খেলতে হয় বিদেশি হিসেবেই। টেস্টে আয়ারল্যান্ডের প্রথম বল করা টিম মারটাহও যেমন মিডলসেক্সের হয়ে খেলতে জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছিলেন।
আপাতত ঘরোয়া কাঠামোর ওপরই তাই ভরসা আয়ারল্যান্ডের। যদিও সেটি এখনো ঠিক শীর্ষ মানের নয় বলেই মনে করেন টেক্টর, ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটকে ঠিকঠাক বলতে হবে। তবে যথেষ্ট ম্যাচ হয় না। মাত্র ১৫টি ম্যাচ খেলে প্রতিটি দল। ৯টি টি-টোয়েন্টি, ৬টি এক দিনের ম্যাচ। ফলে যথেষ্ট খেলোয়াড় উঠে আসছে না।’
তবে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগগুলোতে আইরিশ ক্রিকেটাররা নিয়মিত হচ্ছেন। সর্বশেষ বিপিএলে যেমন কার্টিস ক্যাম্ফার, অ্যান্ডি বলবার্নি খেলেছেন। বাংলাদেশ সফরে না আসা জশ লিটল খেলেছেন দ্য হানড্রেডে, খেলবেন সামনের আইপিএলেও। টেক্টর নিজেও পেয়েছেন ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলার স্বাদ।
সিপিএলের সে মৌসুমটা তেমন ভালো না কাটলেও টেক্টরের অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ, ‘খেলতে পেরে ভাগ্যবান মনে করি নিজেকে। অসাধারণ অভিজ্ঞতা, অনেক কিছু শিখেছি। যদিও যেমন চেয়েছিলাম, তেমন ভালো কিছু করতে পারিনি মাঠে। তবে সেখানে খেলার অভিজ্ঞতা তো হলো। ২০২৪ সালে সেখানেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ভিন্ন ভিন্ন মাঠে ভিন্ন ভিন্ন পিচে খেলার অভিজ্ঞতা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের উপকারিতা তো এটাই। কন্ডিশন আর নতুন খেলোয়াড়ের সঙ্গে মেশা—নতুন অভিজ্ঞতা।’
বাংলাদেশেই এখনো অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবের কথা প্রায়ই আলোচনা নয়, আয়ারল্যান্ডের ক্ষেত্রে সেটির অভাব অনুভূত হওয়ার কথা ভালোভাবেই।
বাংলাদেশ সফরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে নিজেদের বাস্তবতা নিয়েও টেক্টর যেমন বললেন, ‘আমাদের অনেক ভালো খেলতে হবে। শুধু স্পিনার নয়, ওদের পেস আক্রমণও তো বেশ ভালো…নিজেদের সামর্থ্যের সেরাটা দিতে হবে এই বাংলাদেশ দলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে। ওরা অনেক ভালো খেলছে। আমরা অবশ্যই তাদের হারাতে পারব, তবে আমাদের সেরাটা খেলতে হবে।’
সিলেটে প্রথম ওয়ানডেতে আয়ারল্যান্ড সেটি পারেনি, টেক্টরও পারেননি। সিলেটে বাকি আরও দুটি ম্যাচ, এরপর চট্টগ্রামে টি-টোয়েন্টি, মিরপুরে টেক্টরদের স্বপ্নের টেস্ট।
নিজের ক্রিকেট-স্বপ্নের কথা বলতে চান বা না চান, টেক্টর নিশ্চয়ই বাংলাদেশ সফরেও স্মরণীয় কিছুই করতে চান। ডিনার টেবিলে বা প্রেমিকার সঙ্গে আলাপেও তো ক্রিকেটই থাকে তাঁর, সে গল্পের রসদ তো জোগাড় করে যেতে হবে।