গ্রুপপর্ব থেকে সুপার এইটে উঠে লক্ষ্যপূরণ হয়েছে আগেই। এখন যা কিছু মিলবে, সবই ‘বোনাস’। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেই কথাটা বলেছেন।
অর্থাৎ সুপার এইটে বাংলাদেশ যদি তিনটি ম্যাচেই হারে, তবু লক্ষ্যপূরণের জন্য লেটার মার্কস পাবে। পরিসংখ্যানই বলছে, ম্যাচ জয়ের সংখ্যা বিচারে এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই সবচেয়ে ভালো খেলেছে বাংলাদেশ। সুপার এইটে তাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারে বড়জোর মন খারাপ হতে পারে, কিন্তু সুপার এইটে সবে তো একটি ম্যাচ গেল। সামনে এখনো ভারত ও আফগানিস্তান। এক হারেই ‘বোনাস’ পাওয়ার সুযোগ তো আর মিলিয়ে যায়নি।
হাথুরুসিংহের বোনাসের কথা বলার পেছনে যুক্তিও আছে। সুপার এইটে কঠিন তিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সম্ভবত খেলোয়াড়দের ফুরফুরে মেজাজে রাখতে চেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনেই খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা নিয়ে খেলার কথা বলেছিলেন। পাশাপাশি এটাও বলেছিলেন, দলে খেলোয়াড়দের আলাদা ভূমিকা আছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলোয়াড়েরা স্বাধীনতা নিয়ে সর্বান্তঃকরণে সেসব ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছেন। জেতার উদগ্র বাসনার ব্যাপারটি অন্য হিসাবে পড়ে। মানে বোনাস। আর বোনাস ব্যাপারটাই এমন যে পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। যেহেতু ক্ষতি নেই, তাই ফুরফুরে মেজাজে কিছু কথা বলে ফেলা উত্তম।
ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অ্যান্টিগার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামের বাইশ গজ নিয়ে নাজমুল বলেছেন, ‘উইকেট একটু মন্থর হলেও ভালো ছিল।’ এরপর সংবাদ সম্মেলনে ইংরেজিতে এক প্রশ্নকর্তার উত্তরে বলেছেন, ‘উইকেট দেখে ফ্লাট মনে হয়েছে। ব্যাটিংয়ের জন্য খুব ভালো উইকেট। আমরা ব্যাটিং ভালো করিনি। এটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। আমাদের ১৬০–১৭০ রান টার্গেট করা উচিত ছিল।’ এরপর বাংলায় এক প্রশ্নকর্তার উত্তরে আবার নাজমুলের কথাটা একটু পাল্টেছে, ‘শুরুর দিকে উইকেটটা একটু মন্থর ছিল। খুব যে একদম বল ব্যাটে আসছিল তা না, সেট ব্যাটসম্যান থাকাটা খুব জরুরি ছিল।’
নাজমুল উইকেট নিয়ে একবার বলেছেন ভালো ছিল, আরেকবার বলেছেন মন্থর, বল ঠিকমতো ব্যাটে আসেনি। ব্যাপারটা বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ইনিংস শুরুর সঙ্গে টি–টোয়েন্টির ‘ইনটেন্ট’–এর যে বৈপরীত্যমতোই।
টি–টোয়েন্টিতে ব্যাটসম্যানদের ইনটেন্ট নিয়ে কয়েক বছর ধরেই প্রচুর চর্চা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরাই বলেন, রান না উঠলে উইকেট জমিয়ে রেখে কী লাভ? কিংবা টি–টোয়েন্টি রানের খেলা, সেখানে ধরে খেলা কতটা যৌক্তিক? অবশ্য পাওয়ারপ্লে পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাটিংটা ঠিক ধরে খেলা সুলভও ছিল না।
কারণ, ধরে খেলা মানে ৩ ওভারে ১ উইকেটে ৮ রান নয়—এটুকু পর্যন্ত ওপেনার লিটন দাসের সংগ্রহ ছিল ১০ বলে ১ রান! অধিনায়ক নাজমুল তখন সবে ক্রিজে। ৫ বলে ৬ রানের পথে একটি চারও মেরেছেন। পরের ওভারে জশ হ্যাজলউডকে ডাউন দ্য উইকেট দিয়ে ছক্কা মেরে নাজমুল ইনটেন্ট বুঝিয়ে দিলেও ওই ওভার শেষে লিটনের সংগ্রহ ১২ বলে ২! দ্রুত রান তুলতে তখন পর্যন্ত লিটনের ইনটেন্ট বলতে বড়জোর দুবার স্কুপ করার চেষ্টা করা। খটকাটা লাগে ঠিক এখানেই।
ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে কোচ খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ‘বোনাস’–এর কথাটা বলে এক অর্থে সুপার এইটের মঞ্চটা উপভোগ করার বার্তাও দিয়েছিলেন। এমনকি ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে নাজমুলও বলেছেন, ‘ফ্রিডম (স্বাধীনতা) খেলার কথা সবাইকে বলা আছে। সবাই যেন ফ্রিডম নিয়ে খেলে। ম্যাচে গিয়ে যার যার প্ল্যান অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করছে, কেন হচ্ছে না, ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা নেই।’ বটে! তাহলে ওভাবে খেলাই ছিল লিটনের পরিকল্পনা! আর অধিনায়ক হিসেবে নাজমুলও জানেন না, পরিকল্পনা কেন কাজে লাগছে না! তাহলে জানেটা কে?
লিটনের ইনিংস (২৫ বলে ১৬, দুটি চার) যখন থেমেছে, খেলা ততক্ষণে নবম ওভারে (৮.৩ ওভার)। স্কোর ২ উইকেটে ৫৮। রান গড়ে ৭ এর নিচে। ৬৪ স্ট্রাইক রেটে এটা যদি হয় লিটনের স্বাধীন খেলার নমুনা, তাহলে সুপার এইটে দলের জন্য খেলার চেয়ে তাঁর ফর্মে ফেরার চেষ্টাটাই বেশি করে চোখে বেঁধে।
সংবাদ সম্মেলনে লিটনের এমন ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ নিয়ে নাজমুলের দেওয়া উত্তরও তাঁর স্বাধীনতা খেলতে বলা কথার বিরোধী, ‘শুরুতে একটু দেখে খেলারই পরিকল্পনা ছিল। আগের ম্যাচগুলোতে ভালো শুরু পাচ্ছিলাম না। ৬ ওভারটা আমরা কীভাবে উইকেট হাতে নিয়ে শেষ করতে পারি, সেই প্ল্যান ছিল। যে পরিকল্পনা ছিল, সে অনুযায়ী আমরা শেষ করতে পেরেছি। আরেকটু ভালো হতে পারত। কিন্তু আমরা খুশি ছিলাম।’
স্বাধীনতা নিয়ে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে ৬ ওভার শেষে ১ উইকেটে ৩৯ রানে যদি কোনো অধিনায়ক খুশি থাকেন, তাহলে আর বলার কী থাকে!