অফিস থেকে তাঁর ছুটি নেওয়া আছে ১৭ জুন পর্যন্ত। হিসাবটা সহজ। বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ ১৪ জুন। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ মানে টুর্নামেন্টেই শেষ ম্যাচ; আর যা–ই হোক, ভারত, পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের গ্রুপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর কতদূর এগোবে? তারা নিশ্চয়ই সেরা দুইয়ে থেকে পরের রাউন্ডের জায়গা করে নেবে না!
কিন্তু সৌরভ নেত্রবালকারের জন্য হিসাবটা এখন জটিল হয়ে গেছে। ছুটি বাড়ানোর আবেদন করতে হতে পারে। কারণ, কানাডার পর পাকিস্তানকেও হারিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন ‘এ’ গ্রুপের শীর্ষে উঠে গেছে। সামনে ভারত ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ। একটা জিতলেই তো সুপার এইটের টিকিট প্রায় নিশ্চিত। আর সেটা নিশ্চিতের আগে নেত্রবালকার যদি আবেদন নাও করেন, অফিসই তাঁকে ছুটি দিয়ে দিতে পারে। নিজেদের একজন কর্মীকে নিয়ে এভাবে গর্বের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার সুযোগ তো আর যখন–তখন আসে না।
কেমন গর্ব—সেটা জানতে ওরাকলের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে চোখ বুলাতে পারেন। বিশ্বখ্যাত মার্কিন বহুজাতিক কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করেন নেত্রবালকার। কাল রাতে ডালাসে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট দল পাকিস্তানকে সুপার ওভারে হারিয়ে দেওয়ার খবর শেয়ার করে ওরাকল ক্যাপশনে লিখেছে, ‘ঐতিহাসিক জয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটকে অভিনন্দন। দল ও আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলী ও ক্রিকেট তারকা সৌরভের জন্য আমরা গর্বিত।’
শুধু ওরাকল নয়, নেত্রবালকার এখন যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটেরই গর্ব। পাকিস্তানের বিপক্ষে টাই হওয়া ম্যাচ সুপার ওভারে গড়ানোর পর এই বাঁহাতি পেসার দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওভারটি করেছেন। যেখানে ১৮ রান তাড়া করতে নামা পাকিস্তানকে আটকে দেন ১৩ রানে। ৩২ বছর বয়সী নেত্রবালকারের যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও একটি পরিচয় আছে। তিনি ভারতীয়, ২০১০ সালে লোকেশ রাহুল, মায়াঙ্ক আগারওয়ালদের সঙ্গে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপেও খেলেছেন। নিউজিল্যান্ডে হওয়া সে আসরে ভারতের যাত্রা থেমে গিয়েছিল পাকিস্তানের কাছে। বাবর আজম, আহমেদ শেহজাদদের সেই দলের কাছে শেষ ওভারে ২ উইকেটে হেরেছিল নেত্রবালকারের দল। সে স্মৃতি স্মরণ করে আইপিএলের দল লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসহ অনেকেই পোস্ট দিয়েছেন, ১৪ বছর পর নেত্রবালকারের প্রতিশোধ!
নেত্রবালকার প্রতিশোধ মনে করেন কি না, কিংবা ভারতের জার্সিতে পাকিস্তানের কাছে হারের স্মৃতি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলে জয়ের পর তাঁর মনে পড়েছে কি না, সেটা তিনিই ভালো জানেন। তবে মুম্বাই থেকে উঠে আসা এই ক্রিকেটার–কম্পিউটারবিজ্ঞানীর ক্যারিয়ারের যাত্রাপথ বলছে, এ তাঁর চক্রপূরণের মুহূর্ত। ২০০৯ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার স্পোর্টস স্কলারশিপে থাকার সময় বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির এক খেলায় সে সময়ের তারকা ক্রিকেটার যুবরাজ সিংয়ের স্টাম্প ভেঙে দিয়েছিলেন। যে বোলিং তাঁকে বিসিসিআই করপোরেট ট্রফিতে জায়গা করে দেয়।
ভারতীয় বোর্ড তখন করপোরেট ট্রফিকে বেশ গুরুত্ব দিত, নেত্রবালকার খেলার সুযোগ পান যুবরাজ, সুরেশ রায়না, রবিন উথাপ্পাদের সঙ্গে। ১৮ বছর বয়সী নেত্রবালকার সে টুর্নামেন্টে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করে ডাক পান ভারতের অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপের দলেও। ততদিনে ভারতে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতকে ভর্তি হয়ে গেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ খেলবেন বলে প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা মিস করে বসেন।
সেই শুরু। গত দেড় দশক ধরে এই ক্রিকেট আর কম্পিউটার প্রকৌশল লুকোচুরিতেই দিন কাটছে তাঁর।
অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপে ভারতের সর্বোচ্চ উইকেট ছিল নেত্রবালকারের (৬ ম্যাচে ৯ উইকেট)। এমন সাফল্যের পর ভারত জাতীয় দলে ঢোকার পথ অনেকটাই দৃষ্টিসীমায় চলে আসার কথা। অন্তত আইপিএল দলে ডাক পাওয়া কিংবা ঘরোয়া দল মুম্বাইয়ের নিয়মিত অংশ হওয়ার আশা তো ছিলই। কিন্তু মুম্বাইয়ে তখন অজিত আগারকার, জহির খান, আভিষ্কার সালবি ও ধাওয়াল কুলকার্নিরা জেঁকে বসেছেন, নেত্রবালকারের জায়গা পাওয়া তাই কঠিনই ছিল।
তবু ক্রিকেটে থাকবেন বলে ২০১৩ সালে পুনের একটি সফটওয়্যার টেস্টিং কোম্পানির চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এর কয়েক মাস পরই মুম্বাইয়ের হয়ে অভিষেক হয় রঞ্জি ট্রফিতে। তবে ভারত জাতীয় দলে ঢোকার রাস্তাটা খুলতে পারছিলেন না কিছুতেই। কম্পিউটার প্রকৌশলে নেওয়া ডিগ্রিটাও কাজে লাগছিল না। ভাবলেন, নিজের প্যাশন–প্রফেশনের রসায়ন ঘটিয়ে কিছু করা দরকার। সে চিন্তা থেকেই ২০১৪ সালে তৈরি করলেন ক্রিকডিকোড নামের একটি অ্যাপ। এই মোবাইল অ্যাপে ক্রিকেটাররা তাঁদের খেলা বিশ্লেষণ করতে পারেন।
এই কোডিংয়ের দক্ষতা বা প্রকৌশল জ্ঞান আর উল্টো দিকে ভারতের ক্রিকেটে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ—দুয়ে মিলিয়ে ২০১৫ সালে নেন নতুন সিদ্ধান্ত। ভর্তির সুযোগ পান যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার প্রকৌশল স্নাতকোত্তরে। ২০১৮ সালে ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নেত্রবালকারের বক্তব্য ছিল এরকম, ‘সত্যি বলতে, যুক্তরাষ্ট্রে আসার সময় আমি আমার ক্রিকেট খেলার জুতা জোড়াও আনিনি। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল পড়াশোনায়। (স্থানীয় ক্রিকেট খেলা দেখে) পরেরবার ভারত গিয়ে নিজের খেলার সামগ্রীগুলো নিয়ে আসি।’
২০১৬ সালের মে মাসে মাস্টার্স শেষ করে দুটি পথ ছিল নেত্রবালকারের সামনে। প্রথমত, ভারতের ফিরে প্রকৌশলে কাজ করা এবং আবার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সান ফ্রান্সিসকোতে চলে যাওয়া, যেখানে ওরাকলের চাকরির প্রস্তাব আছে। খেলা চালিয়ে গেলে একটা সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জার্সি গায়ে তোলার সুযোগ মিলবে। নেত্রবালকার দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেন।
তবে এটাও খুব একটা সহজ ছিল না। চাকরি, সঙ্গে খেলাধুলার অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া, ‘অনুশীলনের দরকার ছিল। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে থাকতে পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হতো, কদাচিৎ অনুশীলন করতে পারতাম। যখন ওরাকলে এলাম, ওখানে অনুশীলনের অভাব। কাজের শেষে সময় বের করে অনুশীলনের জন্য নিজেকে ভেতর থেকে উদ্দীপিত করতে হতো। ওখানে খেলা খুব কম হতো। আমি তাই বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ খুঁজতাম।’
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে নর্থ ওয়েস্ট রিজিয়নের হয়ে খেলেন নেত্রবালকার। এর মধ্যেই জেনে নেন যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলের হয়ে খেলতে কী কী দরকার। যা জানার পর ক্রিকেটে পরিশ্রম বাড়িয়ে দেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনি ও রোববার। নেত্রবালকার প্রতি সপ্তাহে দুটি শহরে খেলার লক্ষ্য নেন। শ্রীনিবাস সালভার নামের এক সতীর্থকে নিয়ে শুক্রবার কাজ শেষ করে রাতে সান ফ্রান্সিসকো থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে যেতেন। দুজনে তিন ঘণ্টা করে ছয় ঘণ্টার ড্রাইভিংয়ে যেতেন আরেক সতীর্থের বাড়িতে। সেখানে থেকে শনিবার খেলতেন। এরপর সান ফ্রান্সিসকোয় ফিরে আরেকটা ম্যাচ খেলতেন। ক্রিকেট নিয়ে এসব দৌড়ঝাঁপে মা–বাবার মানা থাকলেও টার্ফ উইকেটের জন্য লস অ্যাঞ্জেলে নিয়মিতই যাতায়াত করতেন তিনি।
এই লস অ্যাঞ্জেলেসেই ২০১৭–এর গ্রীষ্মে খেলেন মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ম্যাচ। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ইলেভেনের হয়ে নামা নেত্রবালকার যুক্তরাষ্ট্র একাদশের বিপক্ষে ৯ ওভার বল করে নেন ৩০ রানে ২ উইকেট। যা দেখে মুগ্ধ হন যুক্তরাষ্ট্রের কোচ পুবুদু দেসানায়েকে। যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান কিছুদিন পরেই। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে অভিষেক ম্যাচ খেলেন লিওয়ার্ড আইল্যান্ডসের বিপক্ষে, নেন ৪৫ রানে ২ উইকেট।
এর পরের পথটা অনেকেরই জানা। অভিষেকের বছরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র দলের অধিনায়ক করা হয় তাঁকে। বোলিংয়ে মনোযোগ দেওয়ার জন্য যে দায়িত্ব তিনি ২০২১ সালে ছেড়ে দেন। মনোযোগ দেওয়াটা খুব বৃথা যায়নি, সেটা বোঝা যায় র্যাঙ্কিংয়েও। ২০২৩ সালের জুনে আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের ১৮ নম্বরে উঠে আসে তাঁর নাম, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বোলারের সেরা বিশে থাকা এটিই প্রথম।
৬ জুন ২০২৪ তারিখে নেত্রবালকার যুক্তরাষ্ট্রকে এনে দিয়েছেন আরেকটি ‘প্রথম’। আইসিসির পূর্ণ সদস্য কোনো দলের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের এটাই প্রথম জয়। যে জয়ে একজন ক্রিকেটার আছেন, আছেন কম্পিউটার প্রকৌশলীও। যার এখন ছুটির মেয়াদ বাড়ছে বলে!