অ্যালেক্স হেলস সেঞ্চুরির সুবাস পাচ্ছিলেন তখন। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের রান তাড়ায় লক্ষ্য এত কমে এসেছিল যে সেঞ্চুরি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল।
তবে একটি বিষয়ে ততক্ষণে আর কোনো সংশয় ছিল না। ইংলিশ ক্রিকেটে যে মানুষটি অপাঙেক্তয় হয়ে পড়েছিলেন, ইংল্যান্ড দলে আর কখনো খেলতে পারবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছিল, সেই হেলসই ইংল্যান্ডকে তুলছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে। ক্রিকেট সত্যিই ভীষণ মজার খেলা!
অ্যাডিলেডে আজ যে সেমিফাইনাল ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হলো, সেখানে সব খেলোয়াড় ও দর্শকের মধ্যে হেলস নিশ্চিতভাবেই এই মজাটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছেন। ভারতের দুর্দান্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে ১৬৮ রান তাড়া করতে নেমে ২৪ বল হাতে রেখে ১০ উইকেটের জয়—সেখানে হেলসের একারই অবদান ৪৭ বলে অপরাজিত ৮৬। ৭ ছক্কা ও ৪ চারে সাজানো ইনিংসটি দিয়ে হেলস নিশ্চিতভাবেই ভারতের বোলারদের ‘দোজখ’ উপহার দিয়েছেন। মোহাম্মদ শামি-ভুবনেশ্বর কুমাররা তাতে যেমন পুড়েছেন, হেলসও তেমনি উপভোগ করেছেন।
একটু ভুল হলো। উপভোগ না বলে প্রত্যাবর্তনের সময়টা রাঙাচ্ছেন বলাই ভালো। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হেলস যে বড় কিছু হবেন, সেটি বোঝা যায় পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে ট্রেন্ট ব্রিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১২২ বলে ১৭১ রানের সেই ইনিংসে। কিন্তু সময় তো মানুষের এক রকম যায় না।
বিনোদনমূলক ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে ২০১৯ বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে বাদ পড়েন ইংল্যান্ড দল থেকে। সেই দুঃখ হেলসকে এতটাই কুরে কুরে খেয়েছিল যে ইংল্যান্ড ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পরও হেলস বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। হ্যাঁ, ওরা বিশ্বকাপ জেতায় ভালো লাগছে। তবে ভেতরে-ভেতরে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল এই ভেবে যে দলের এই উৎসবে আমিও সঙ্গী হতে পারতাম।’
অথচ হেলসের সেই বিশ্বকাপের আগে বিনোদনমূলক ড্রাগ নেওয়ার ভুলটা করার কথা ছিল না। এমন ভুল যেন না করেন, সেই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন ২০১৭ সালেই। ব্রিস্টলে এক পানশালার বাইরে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সঙ্গী ছিলেন তখন হেলসের বন্ধু বেন স্টোকস।
হেলস সে জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, জরিমানাও দিতে হয়েছিল। সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন। কিন্তু প্রতিভাবানরা যেমন হয়ে থাকেন—আজ যেমন ভালো লেংথের বল ব্যাটে আসায় প্রায় সবই মেরে খেলেছেন—একটু অপরিণামদর্শী, নিজের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখায় কোনো বাছবিচার থাকে না, হেলসও বোধ হয় সেই অতি আত্মবিশ্বাস থেকে দ্বিতীয়বার ভুলটি করে বসেন।
এউইন মরগান তাঁকে ক্ষমা করেননি। যত দিন অধিনায়ক ছিলেন, হেলসকে ইংল্যান্ডের সাদা বলের স্কোয়াডের ধারেকাছেও আসতে দেননি মরগান। তবে গত বছর নাগাদ হেলসের প্রতি মনটা নরম হয়ে এসেছিল মরগানের। আর হেলস নিজেও ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিতে রানের পর রান করে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নে তা দিতে শুরু করেন। ২০২২ সালের মধ্যে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে তুলে ফেলেন ৪৮২৭ রান। ইংলিশ ক্রিকেটের বিজ্ঞজনেরা টের পেতে শুরু করেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁকে দরকার। এর মধ্যে ইংল্যান্ড দলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রব কি-র কাছে ফোন করে হেলস জানতে চান, কেন তিনি দলে নেই?
কী কপাল! জনি বেয়ারস্টো চোটে পড়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে একেবারে শেষ মুহূর্তে জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় হেলসের। অবশ্য এর আগে কি সে সময় ইংল্যান্ড দলের সব খেলোয়াড়ের কাছে ফোনে জানতে চেয়েছিলেন, হেলসকে দলে নেওয়া যায় কি না? কেউ তাঁর জন্য সেই দরজা খুলেছে বললে ভুল হয়, হেলস ব্যাটের পারফরম্যান্সে নিজেই সেই শিকল ছিঁড়ে ফিরেছেন। আর ফেরাটাও হলো কী দুর্দান্ত!
সুপার টুয়েলভে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫২, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৭ রানের ইনিংসের পর আজ ভারতের বিপক্ষে হেলস যে ইনিংসটি খেলেছেন, তাতে নিশ্চিতভাবেই দলে জায়গাটা পোক্ত হয়ে গেল তাঁর। ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে হেলসের কথাগুলো শুনলে তাই আবেগ ছুঁয়ে যেতে পারে, ‘কখনো ভাবিনি বিশ্বকাপে আমি আবারও খেলতে পারব। সুযোগ পাওয়ার অনুভূতিটা দুর্দান্ত। এখানে (অস্ট্রেলিয়ায়) খেলতে ভালোবাসি আমি।’
হেলসকেও দু-একজন ভালোবাসেন। ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার ডেভিড লয়েড যেমন টুইট করেছেন, ‘অ্যালেক্স হেলস...দায়মোচন...লেগে থাকলে যে বাজে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা যায়, এটাই তার প্রমাণ।’
হেলসকে দেখে শুধু ক্রিকেটাররা নয়, সাধারণ মানুষও শিক্ষা নিতে পারেন!