সম্প্রতি শেষ হওয়া ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজে অনেকবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সেটা কখনো ৫০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়ে, কখনো ১০০ টেস্ট খেলার কীর্তি গড়ে, আবার কখনো ম্যাচের গতিপথ বদলে দেওয়া বোলিং করে। ৫০০ উইকেট ছোঁয়ার দিনে অশ্বিন আরও একটা কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন; সেটা মাঠের বাইরের ঘটনায়।
রাজকোট টেস্টের দ্বিতীয় দিনে মায়ের অসুস্থতায় দল ছেড়ে চেন্নাই যেতে হয়েছিল অশ্বিনকে, যেটা তাঁর জন্য মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। কঠিন এই কাজ অশ্বিন সহজে করতে পেরেছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মার জন্য। শুধু রোহিত নন, কোচ রাহুল দ্রাবিড়সহ পুরো ভারতীয় দলই অশ্বিনের পাশে ছিল। এমনকি দলের বাইরে থাকা চেতেশ্বর পূজারাও তখন অশ্বিনকে সহযোগিতা করেছেন। সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত অশ্বিন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে জানিয়েছেন।
অশ্বিন বলেছেন, ‘ঘটনাটা ঘটে টেস্টের দ্বিতীয় দিন, যদিও অনেক কিছুই এখন ঝাপসা হয়ে গেছে। ৪৯৯ উইকেটে ছিলাম, আশা করেছিলাম ভাইজাগেই মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলব, সেটা হয়নি। রাজকোট টেস্টে দ্বিতীয় দিন জ্যাক ক্রলিকে আউট করি, খুব একটা ভালো বল না হলেও মাইলফলকে পৌঁছাই। দিনের খেলা শেষে কিছু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হই, প্রেস এরিয়াতে যাই। মাত্র ৫০০ উইকেট নিলাম, স্ত্রী বা বাবার কাছ থেকে ফোন আশা করেছিলাম। ৭টা বেজে যাওয়ার পরও ফোন না আসার কারণে অবাক হই। কিন্তু ভেবেছিলাম সাক্ষাৎকার কিংবা অভিনন্দনবার্তার প্রতিক্রিয়া দিতে দিতে তারাও ব্যস্ত। তাই বেশি কিছু আর ভাবিনি।’
বেশি কিছু ভাবতে না চাইলেও অশ্বিনের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল, ‘মা-বাবাকে ফোনে না পেয়ে অবশেষে আমার স্ত্রীকে ফোনে পাই। ওর কণ্ঠ ভেঙে ভেঙে আসছিল। ওকে বললাম গোসল করতে যাচ্ছি, কিন্তু ও আমাকে অন্য খেলোয়াড়দের থেকে দূরে কোথাও একা যেতে বলল। ও বলল, আমার মা প্রচণ্ড মাথাব্যথার পর জ্ঞান হারিয়েছে।’
এমন খবর পেয়ে কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না অশ্বিন, ‘নিজেকে যেন শূন্য মনে হচ্ছিল, আমি কী করেছি মনে নেই, তবে আমি কাঁদছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, ওকে (স্ত্রী) কী জিজ্ঞাসা করব। আমি চাইনি, কেউ আমাকে কাঁদতে দেখুক, এটা সহজাত প্রতিক্রিয়া ছিল। কী করব বুঝতে না পেরে আমি আমার ঘরে একা বসে ছিলাম। আমি জানতাম, আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে, কিন্তু এটাও ভাবছিলাম, কীভাবে আমার সতীর্থদের ফেলে চলে যাব। ভারসাম্য রাখতে পারছিলাম না। কোচ আর অধিনায়ককেই–বা কী বলব। আমি একাদশের একজন, যদি বাড়ি চলে যাই, তাহলে আমাদের মাত্র ১০ জন খেলোয়াড় থাকবে, যা ইংল্যান্ডকে বাড়তি সুবিধা দেবে।’
অশ্বিন যোগ করেন, ‘কিন্তু মায়ের কথাও ভাবছিলাম এবং সর্বশেষ কখন তার সঙ্গে কথা বলেছি, সেটাও ভেবেছি। আমি জানতাম, আমাকে বাড়ি ফিরে তাকে দেখতে হবে, কিন্তু চিকিৎসকেরা আমাদের জানিয়েছিলেন, কাউকে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হবে না।’
দৃশ্যপটে রোহিতের আবির্ভাব হয় এরপরই। অশ্বিন বলছেন, ‘যেহেতু আমি তাদের ফোন রিসিভ করছিলাম না, তাই আমার স্ত্রী নিশ্চয়ই রোহিত ও দ্রাবিড়কে খবরটি জানিয়েছে। রোহিত ভেতরে এসে আমাকে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘কী করছ? তোমাকে এখনই যেতে হবে। ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাও।’
অশ্বিনের এরপরের চ্যালেঞ্জ ছিল দ্রুত চেন্নাই ফেরার ব্যবস্থা করা। এ কাজে অশ্বিনকে সহায়তা করেন পূজারা, ‘চেতেশ্বর পূজারাকে ধন্যবাদ দিতে হবে, যে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার জন্য চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে।’
ফ্লাইটে এরপর রোহিত অশ্বিনের সঙ্গে পাঠান ভারত দলের ফিজিও কমলেশকে। অশ্বিন ভারত অধিনায়ক রোহিতকে প্রশংসায় ভাসিয়ে বলেন, ‘আমাদের টিম ফিজিও কমলেশ আমার ভালো বন্ধু। রোহিত কমলেশকে আমার সঙ্গে চেন্নাই যেতে বলে, দলে মাত্র দুজন ফিজিও থাকা সত্ত্বেও। আমি কমলেশকে বললাম, “সমস্যা নেই, তুমি থাকো।” কিন্তু আমি বিমানে উঠতে গিয়ে দেখি, কমলেশ ও একজন নিরাপত্তাকর্মী আগে থেকেই সেখানে আছে। শুধু তা–ই নয়, রোহিত বারবার কমলেশকে ফোন করছিল আমার অবস্থা জানার জন্য। এটা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। আমাদের মতো স্বার্থপর সমাজে যে অন্য কারও ভালোর কথা চিন্তা করে, সে সত্যিই মহৎ।’
অশ্বিন যোগ করেন, ‘রোহিত বিশেষ একজন মানুষ, অসাধারণ নেতা, হৃদয়টাও অনেক বড়। আমি নিজেই এর সাক্ষী। মাঠে তার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব, সে এমনই একজন অধিনায়ক। এই গুণগুলোর কারণেই সে পাঁচটি আইপিএলসহ অনেক শিরোপা জিতেছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, রোহিত তার ক্যারিয়ার এবং জীবনে আরও বেশি অর্জন করুক।’
অশ্বিনের দেখার পর মায়ের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, সেটাও জানিয়েছেন অশ্বিন, ‘আমার মা আমাকে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। আর এটাই আজকের ও আগের প্রজন্মের মা–বাবার মধ্যে পার্থক্য। তিনি শুধু আমার জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো, তা–ই চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, আমি দলের সঙ্গেই থাকি। এমনকি ওই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি আমাকে নিয়েই ভাবছিলেন।’
অশ্বিন অবশ্য রাজকোট টেস্টে চতুর্থ দিনে আবার দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি দ্বিতীয় টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট নিয়েছিলেন ৩টি। ভারতও সে টেস্ট জেতে ১০৬ রানে। আর অশ্বিন ২৬ উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক।