এক ফ্রেমে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান
এক ফ্রেমে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান

‘আনফিট’ তামিমকে বিশ্বকাপে চান না সাকিব-হাথুরুসিংহে

‘কাউন্ট ডাউন’টা এই মুহূর্তে চালু করে দিলে বলতে হয়, ‘আর মাত্র ১১ দিন।’ সেটা ৭ অক্টোবর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের প্রথম ম্যাচ ধরলে। আর বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ-যাত্রার কথা বললে ‘কাউন্ট ডাউন’ এখন করতে হবে ঘণ্টা হিসাবে। কারণ, কাল বিকেলেই ভারতের বিমান ধরবে বাংলাদেশ দল।

বিশ্বকাপ যাত্রার ২৪ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় আগ পর্যন্তও ঘোষণা হয়নি বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দল, বিস্মিত হওয়ার জন্য এটাই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে বাড়তি মাত্রা যোগ করছে বিশ্বকাপ–যাত্রার এক দিন আগেও বিশ্বকাপ দল নিয়ে অনিশ্চয়তা। কারণ, কাল গভীর রাতে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের বাসায় হওয়া এক সভায় অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এবং কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বোর্ড সভাপতিকে জানিয়েছেন, বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে তারা কোনো ‘আনফিট’ বা ‘অর্ধেক ফিট’ ক্রিকেটারকে দলে চান না। এমনকি তিনি যদি হন তামিম ইকবালের মতো অভিজ্ঞ কেউও। সাকিব নাকি এমনও বলেছেন, আনফিট কেউ দলে থাকলে তিনি বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করবেন না।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চলতি সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডের পর তামিম নিজেই সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি এখনো পুরোপুরি ফিট নন। এরপর একই কথা তিনি ব্যক্তিগতভাবে বোর্ডের কয়েকজন পরিচালককে বলেছেন, বলেছেন নির্বাচকদেরও। তামিম যেহেতু কয়েক মাস ধরেই পিঠের সমস্যায় আক্রান্ত এবং তাঁর সমস্যাটাই এমন যে এটি যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে; বিশ্বকাপ দল ঘোষণার আগে তাঁর শারীরিক অবস্থা জানাটা জরুরি ছিল নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের জন্য।

নিজের জায়গা থেকে সৎ থাকতে বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, যেটি বাস্তব সেটিই তামিম তাঁদের জানিয়েছেন। বলেছেন, বিশ্বকাপের দলে যদি তাঁকে রাখা হয়, তাহলে যেন এটা বিবেচনা করেই রাখা হয় যে তিনি পুরোপুরি ফিট নন। স্বাভাবিকভাবেই টিম ম্যানেজমেন্ট এবং নির্বাচকদের কাছে এ কথার অনুবাদ দাঁড়িয়েছে অনেকটা এ রকম, তামিমকে দলে নিলেও হয়তো সব ম্যাচে তাঁকে পাওয়া যাবে না। তাহলে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে এই বোঝা কি বইবে বাংলাদেশ?

একসঙ্গে সাকিব, তামিম ও চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

এটা ঠিক যে অন্তত ৯ ম্যাচ খেলতে হবে যে টুর্নামেন্টে, সেই টুর্নামেন্টে কোনো খেলোয়াড়েরই সব ম্যাচে খেলার নিশ্চয়তা আগে থেকে দেওয়া যায় না। কেউ চোটে পড়তে পারেন, কাউকে বিশ্রাম দিতে হতে পারে, আবার টিম কম্বিনেশনের কারণেও কোনো ম্যাচে কেউ দলের বাইরে থাকতে পারেন। তবে সেসবই ঘটে টুর্নামেন্ট শুরুর পর পরিস্থিতির প্রয়োজনে। যখন আগে থেকেই কেউ বারবার বলতে থাকেন ‘আমি ফিট নই’, ‘আমি ফিট নই’—তখন এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে জেনেশুনে কেন একজন স্বঘোষিত ‘আনফিট’ খেলোয়াড়কে দলের সঙ্গে রাখা? এর চেয়ে একটু কম অভিজ্ঞ হলেও পুরো ফিট কাউকে নেওয়াই তো ভালো।

জানা গেছে, কোচ-অধিনায়কও সেই চিন্তা থেকেই কাল রাতে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন বোর্ড সভাপতিকে। নিউজিল্যান্ড সিরিজের দলে না থাকা ওপেনার মোহাম্মদ নাঈমকে আজ দুপুরে হাথুরুসিংহের মিরপুরে ডেকে আনাও যেন কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। তবে এসবের যোগফল অবশ্যই এই নয় যে ভারত বিশ্বকাপের দলে তামিমের না থাকাটা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। কোচ-অধিনায়কের মতকে গুরুত্ব দিয়ে বোর্ড তামিমকে ছাড়াই বিশ্বকাপের দল গড়তে পারে, এই সম্ভাবনা যেমন আছে; তেমনি এত কিছুর পরও তামিমের বিশ্বকাপ দলে থাকারও জোর সম্ভাবনা আছে।

বিষয়টি চূড়ান্তভাবে জানা যাবে আজ বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড তৃতীয় ওয়ানডের ইনিংস বিরতির সময়, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটু অভিনবভাবেই ঘোষিত হবে ভারত বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দল। তার আগে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান হয়তো শেষবারের মতো বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

এর আগে অবসরের ঘোষণা দিয়েও ফিরে আসেন তামিম ইকবাল

মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বকাপ দল নিয়ে অনিশ্চয়তায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে যে তামিম, মাস তিনেক আগেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক এবং এই বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের খেলার কথা ছিল তাঁর অধীনেই। তাতে কী! বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দল নিয়ে নাটকীয় কিছু হবে না, সেটা তো আর হয় না? সে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেই এবার চলছে ‘তামিম এপিসোড।’

এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তামিম ইকবাল বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং নির্ভরশীল ওপেনার। ফর্ম হয়তো এখন অতটা উত্তুঙ্গ নয়, তবে এমনও নয় যে এর মধ্যে তাঁর অনুপস্থিতিতে যাঁরা ওপেনিংয়ে সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা খুব আস্থার প্রমাণ দিতে পেরেছেন। উল্টো আরেক অভিজ্ঞ ওপেনার লিটন দাসই হারিয়ে বসেছেন ফর্ম! ক্রিকেটীয় দিক থেকে তাই বিশ্বকাপের দল থেকে তামিমকে বাদ দেওয়ার চিন্তা করাটা কঠিন।

সেটি সহজ নয় অন্য কারণেও। গত জুলাইয়ে আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণার পর যে প্রক্রিয়ায় তামিম আবার খেলায় ফিরেছেন, সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলও সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল। তামিম তাঁর এত বড় সিদ্ধান্ত বদলেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। কাজেই বিশ্বকাপের দলে তাঁকে না রাখার সিদ্ধান্তটাও হয়তো একা বোর্ডের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান

সংক্ষিপ্ত ওই ইতিহাস যেমন তামিমের পক্ষে আছে, তাঁর কারণেই আবার টিম ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ডের আবহ অনেকটাই তাঁর বিপক্ষে চলে গেছে। নিজের ফিটনেস নিয়ে নিজেই বারবার সংশয় প্রকাশ করে সবার মধ্যে তামিম এমন ধারণাই ছড়িয়ে দিয়েছেন যে তিনি হয়তো আগে থেকেই একটা অজুহাতের পিলার পুঁতে রাখতে চাচ্ছেন। বিশ্বকাপে ভালো না খেললে খারাপ খেলার দায়টা যেন ফিটনেসের ওপর দিয়ে যায়। তখন তাঁর বলার সুযোগ থাকবে, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম...।’

অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সঙ্গে তামিম ইকবালের ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি বেশ পুরোনো খবর হলেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে সেটি আবারও সামনে চলে এসেছে। কারও কারও এমনও মত, তামিম হয়তো আশঙ্কা করছেন, সাকিবের অধীনে তিনি দলে স্বস্তিতে থাকবেন না। আবার কেউ বলছেন, অধিনায়ক সাকিবকে অস্বস্তিতে রাখতেই বিশ্বকাপের আগে নিজের চোটকে আবারও টালমাটালভাবে উপস্থাপন করছেন তামিম। বললে হয়তো খারাপ শোনাবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো খোদ দল সংশ্লিষ্ট কারও কারও মনে এমন প্রশ্নও আছে—সাকিবের অধীনে তামিম তাঁর পুরো সামর্থ্য দিয়ে খেলবেন তো!

সব মিলিয়ে তামিমকে বাদ দিয়েই বিশ্বকাপের দল ঘোষণার মতটা ভারী বিসিবিতে। তবে সিদ্ধান্ত যেটাই হোক, তা নিশ্চিত হতে আর ‘মাত্র’ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। তামিম বিশ্বকাপ দলে থাকবেন, নাকি থাকবেন না!