জোন্সকে নিয়ে পেসার আলী খানের উল্লাস
জোন্সকে নিয়ে পেসার আলী খানের উল্লাস

উৎপল শুভ্রর লেখা

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্মরণীয় এক অভিষেক

এমন শুনেছেন কখনো, কোনো টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হচ্ছে প্রথম ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পর! ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নতুন অনেক কিছুই দেখছে ক্রিকেট। এর মধ্যে এটাও একটি। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ডালাসে, আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কিনা গায়ানায়! ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাপুয়া নিউ গিনি দ্বিতীয় ম্যাচের আগে।

ডালাসের আয়োজকেরা অবশ্য বলতেই পারেন, কেন, আমাদের এখানেও কি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল না? টস হয়ে যাওয়ার পর ম্যাচ শুরু হওয়ার মাঝের সময়টায় আনন্দ-উল্লাস কি কম হয়েছে এখানে!

কম না বেশি—এ নিয়ে কথা হতেই পারে। তবে আনন্দ-উল্লাস যে হয়েছে, তা না মেনে উপায় নেই। হোক না তা মিনিট পনেরো-বিশের। বিশ্বকাপের ২০ দেশের পতাকা প্রদর্শনীর পর রং–বেরঙের পোশাক পরে ব্যান্ড দল ঢুকল মাঠে। বাজনা বাজল, সঙ্গে নাচ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মতো বেশধারী চার তরুণ হাতের যন্ত্রটা থেকে কুণ্ডলী ওঠা ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন আকাশে। থাকল আতশবাজিও। যদিও দিনের আলোতে আতশবাজি কি আর তেমন জমে নাকি!

ডালাসে ৮টা-সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। সন্ধ্যার ম্যাচ তাই দিনের আলো থাকতেই শুরু। সেই আলো প্রায় সারা দিনই অবশ্য ম্রিয়মাণ হয়ে ছিল। গত মঙ্গলবার ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে ডালাসে ঝড়বৃষ্টি লেগেই আছে। প্রবল সেই ঘূর্ণিঝড়ের রেশ এখনো আছে। গাছ পড়েছে রাস্তায়। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেক জায়গায়। পুরো ডালাসের কথা ধরলে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

জোন্স আজ একাই ১০ ছক্কা মেরেছেন

এখানে ঝড়বৃষ্টির হাত ধরেই আসে চকিত বন্যা। রাস্তা-বাড়িঘর প্লাবিত হয়। ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’ সতর্কবার্তা নিয়মিতই দেখছি টেলিভিশনে। সঙ্গে আরও ঝড়ের পূর্বাভাসও। গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামকেও ছাড়েনি ঝড়। বড় পর্দা খুলে পড়ে গিয়েছিল। বিশ্বকাপের জন্য একটু গুছিয়ে আনা স্টেডিয়াম পুরোই লন্ডভন্ড। তা আবার ঠিকঠাক করার চেষ্টাতেও বাদ সাধছিল বৃষ্টি। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিরতিহীন বৃষ্টিতে তো রীতিমতো সংশয়—যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপের বহুল প্রতীক্ষিত অভিষেকের না সলিলসমাধি হয়ে যায়! এই মাঠেই তো দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ হতে পারেনি ঝড়বৃষ্টির কারণে। যার মধ্যে একটি ছিল আবার বাংলাদেশের।

বিকেলের আগেই অবশ্য বৃষ্টি থেমে গেছে। আর এখানে বৃষ্টি থেমে গেলে খেলা নিয়ে আর কোনো অনিশ্চয়তা থাকে না। ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের মাঠের আধুনিকতম পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা বুঝতেই দেয় না যে একটু আগেই এখানে অঝোরে বৃষ্টি পড়েছে। এর মহিমাটা পুরো বুঝতে প্রেসবক্সের পেছনে মাঠটায় পা রাখলেই চলছে। যেখানে ঘাসের নিচে পানি জমে আছে, কাদায় মাখামাখি অবস্থা।

ফিফটি পেয়েছেন গুসও

গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে কত দর্শক ধরে, এই প্রশ্নের তিন রকম উত্তর পাওয়া গেল। কেউ বলছেন ৬ হাজার, কেউ ৭, কেউবা ৮ হাজার। সঠিক সংখ্যা যেটাই হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ম্যাচে গ্যালারি পুরো ভরবে কি না, এ নিয়ে একটা সংশয় ছিল। ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যা উধাও। কিছু চেয়ার খালি পড়ে থাকতে দেখা গেল, তবে তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।

দর্শক ধারণক্ষমতা কম থাকতে পারে, তবে সুযোগ-সুবিধায় আধুনিকতম। সেটাই শুধু সমস্যা করছিল, নইলে গ্যালারি দেখে কারও মনে হতেই পারত, খেলাটা বোধ হয় উপমহাদেশে হচ্ছে। বেশির ভাগই দক্ষিণ এশিয়ান, অনুমিতভাবেই ভারতীয় সবচেয়ে বেশি। গ্যালারিতে শ্বেতাঙ্গও ছিলেন বেশ কয়েকজন। আইসিসির লোকজন দাবি করলেন, তাঁদের সবাই নাকি নির্ভেজাল আমেরিকান। নির্ভেজাল আমেরিকান বলতে কী বোঝায়, তা অবশ্য একটা প্রশ্ন বটে। আমেরিকায় তো বলতে গেলে সবাই অভিবাসী। কেউ আগে এসেছেন, কেউবা পরে—এই যা।

বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেট একটা অবিশ্বাস ছড়িয়ে দিত। সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাটার সাক্ষী থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, ক্রিকেটের জন্য আসলেই স্মরণীয় এক দিন। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জন্য যা করেছে, ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্যও তা করতে পারবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে চার-ছক্কা হতেই উচ্চ নিনাদে বাজতে থাকা মিউজিক আর ডিজের দর্শককে চাঙা রাখার নিরন্তর চেষ্টায় ক্রিকেটের আমেরিকীকরণ কিছুটা হয়েছে বলেই মনে হলো।

তবে এসব তো বাড়তি চকমকি। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপের স্মরণীয় অভিষেক নিশ্চিত করতে খেলাটাও সে রকম হতে হতো। তা যেমন হলো, তা সম্ভবত ছাড়িয়ে গেছে আইসিসির প্রত্যাশাকেও।

বিশ্বকাপ শুরুর দিন সকালে আমেরিকানদের ক্রিকেটে ঘুম ভাঙাতে স্থানীয় টিভি চ্যানেলের ‘গুড মর্নিং আমেরিকা’ অনুষ্ঠানে থাকলেন আইসিসির বিশেষ দূত যুবরাজ সিং। ক্রিকেট খেলাটা কী, বেসবলের সঙ্গে কোথায় এর পার্থক্য, সেসব সবিস্তার বর্ণনা করতে হলো তাঁকে। অনুষ্ঠানের সেটেই ক্রিকেট খেলার প্রথম পাঠও দিলেন যুবরাজ। তবে এসব দিয়ে আর আমেরিকানদের ভোলানো যাবে না। ওই অনুষ্ঠান দেখার পর কৌতূহলী হয়ে যদি কেউ টেলিভিশনে উদ্বোধনী ম্যাচটা দেখে থাকেন, তাহলেই যুবরাজের চেষ্টা সার্থক।

এমন উল্লাস বল হাতে খুব কম সময়ই করতে পেরেছে কানাডা

আর ম্যাচ দেখে থাকলে ক্রিকেটে অজ্ঞ আমেরিকানদেরও আগ্রহটা বাড়তেই পারে। ম্যাচটা যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দারুণ এক বিজ্ঞাপন! কানাডার ১৯৪ রানের স্কোর যেভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল যুক্তরাষ্ট্র, সেটিও শুরুতে এটিকে অসম্ভব মনে করানোর পর—টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এর চেয়ে ভালো আর কীই-বা হতে পারে!
এরপরও আমেরিকানরা ক্রিকেটে আগ্রহী না হলে কিছু করার নেই। খেলাটাকে এখানে বাঁচিয়ে রেখেছে দক্ষিণ এশিয়ানরা, তারাই খেলুক। আমেরিকানদের বেসবল নিয়ে পড়ে থাকতে দিন।