লিওনেল মেসির হাতেই উঠছে ব্যালন ডি’অর—ব্যাপারটা কদিন ধরে ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে গিয়েছিল। বাস্তবে হলোও তা–ই। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ট্রেবলজয়ী আর্লিং হলান্ডকে পেছনে ফেলে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মেসিই জিতে নিলেন নিজের অষ্টম ব্যালন ডি’অর।
সপ্তম ব্যালন ডি’অর নিয়ে এত দিন এককভাবে মেসিই ছিলেন শীর্ষে। এবার যেন নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেলেন। বার্সেলোনা, পিএসজি হয়ে ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়া মেসি ইদানীং কোনো গোল করলেই যেখানে রেকর্ড বইয়ে নাম উঠে যায়, সেখানে ব্যালন ডি’অর জিতলে রেকর্ড বই তোলপাড় হবে না, তা কি হয়? প্যারিসের থিয়েতার দু শীতেলে গত রাতে অষ্টম ব্যালন ডি’অর হাতে পেয়ে ৯টি কীর্তি গড়ে ফেলেছেন মেসি।
ইউরোপের বাইরে খেলা প্রথম ফুটবলার হিসেবে মেসি ব্যালন ডি’অরের খেতাব জিতলেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ইউরোপের সেরা ফুটবলারকে এই পুরস্কার দেওয়া চালু হয়। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পুরস্কারটি শুধু ইউরোপের খেলোয়াড়দেরই দেওয়া হতো। এর পর থেকে ইউরোপে খেলা বিশ্বের যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য পুরস্কারটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আর ২০০৭ সাল থেকে কেবল ইউরোপে খেলা ফুটবলারকে সেরা নয়, পুরস্কারটি দেওয়া শুরু হয় বিশ্বের যেকোনো জায়গায় খেলা ফুটবলারকে।
২০০৭ থেকে ২০২২—ব্যালন ডি’অর ‘বৈশ্বিক’ হয়ে ওঠার এই ১৫ বছরে যে পাঁচ ফুটবলার জিতেছেন, তাঁরা সবাই ইউরোপে খেলেছেন। মেসি নিজেও আছেন এ তালিকায়। তিনি আগের সাত ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন বার্সেলোনা ও পিএসজির খেলোয়াড় হিসেবে।
তাঁর দীর্ঘ সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জিতেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। কাকা জিতেছেন এসি মিলানে থাকতে। আর লুকা মদরিচ ও করিম বেনজেমাও একবার করে জিতেছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে ২০২০ সালে ব্যালন ডি’অর দেওয়া হয়নি। ফুটবল বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওই বছর এ পুরস্কার জেতার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন রবার্ট লেভানডফস্কি। বার্সার পোলিশ স্ট্রাইকার সে সময় খেলতেন জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। তার মানে, মায়ামির মেসিই ইউরোপের বাইরে খেলা প্রথম ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলার। মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) তথা যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে খেলা প্রথম ব্যালন ডি’অর জয়ী খেলোয়াড়ও তিনি।
কাল সোনার বলটা হাতে তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ভিন্ন তিন দশকে ও ভিন্ন তিন ক্লাবের হয়ে ব্যালন ডি’অর জয়ের কীর্তি গড়েছেন মেসি। আর্জেন্টাইন তারকা এই পুরস্কার প্রথম জেতেন ২০০৯ সালে বার্সার হয়ে। ওই দশকের শেষ বছর মানে ২০১০ সালেও এই স্বীকৃতি মিলেছে। একই ক্লাবের হয়ে পরের দশকে জিতেছেন আরও চারবার—২০১১, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৯ সালে। এই দশকে পিএসজির হয়ে জিতেছেন ২০২১ সালে, এবার জিতলেন ইন্টার মায়ামির হয়ে।
৩৫ বছরের বেশি বয়সে ব্যালন ডি’অর জয়ী প্রথম অ-ইউরোপীয় খেলোয়াড়ও বেশি। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর চেয়ে বেশি সময়ে এই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন শুধু স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুস, সেই ১৯৫৬ সালে। অর্থাৎ সে বছর থেকে ব্যালন ডি’অর দেওয়া শুরু হয়।
প্রথম ও সর্বশেষ ব্যালন ডি’অর জয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবধানের রেকর্ডটা ২০১৯ সালেই ভাঙেন মেসি। রোনালদো এই স্বীকৃতি পাঁচবার পেয়েছেন ৯ বছরের ব্যবধানে। এবার নিয়ে মেসির প্রথম ও সর্বশেষের মধ্যে ব্যবধান হয়ে গেল ১৪ বছরের। এই রেকর্ড অদূর ভবিষ্যতে কেউ ভাঙতে পারবেন বলে মনে হয় না।
প্রথম ফুটবলার হিসেবে ১৪ বার ব্যালন ডি’অর জয়ের দৌড়ে শীর্ষ তিনে থাকলেন মেসি। ২০০৭ সালে হয়েছিলেন তৃতীয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত শুধু দুবার (২০১৮ ও ২০২২) শীর্ষ তিনে ছিলেন না।
ব্যালন ডি’অরে সবচেয়ে বেশি পয়েন্টও এখন মেসির। ২০২১ সাল পর্যন্ত রোনালদোর পয়েন্ট ছিল ৩৭৭৯, মেসির ৩৫৭৪। ২০২২ সালে পয়েন্ট তালিকা জানানো হয়নি। এবারও কে কত পয়েন্ট পেয়েছেন, সেটা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। মেসি গত বছর শীর্ষ ত্রিশে না থাকায় পয়েন্ট যোগ হয়নি। রোনালদো ২০তম হওয়ায় কিছু পয়েন্ট পেয়েছিলেন।
এবার রোনালদো শীর্ষ ত্রিশেও নেই। মানে, পর্তুগিজ তারকা কোনো পয়েন্ট পাননি। আর মেসি হওয়ায় অনেক পয়েন্ট পেয়েছেন। সেটা কত? অতীতের রেকর্ড দেখে জানা গেল, মেসি এর আগে যতবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন, ততবারই ন্যূনতম ৬০০ পয়েন্ট পেয়েছেন। এবারও যদি ৬০০ পয়েন্ট পেয়ে থাকলে অনায়াসে রোনালদোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা।
মেসি এবার ব্যালন ডি’অর জিতে আর্জেন্টিনাকেও সবার ওপরে তুলেছেন। তাঁর অষ্টম ব্যালন ডি’অর জয়ে সবচেয়ে বেশিবার এই সম্মাননা পাওয়া দেশ আর্জেন্টিনা। সাতবার করে এই খেতাব জিতেছে ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগাল। ফ্রান্স ও জার্মানির পাঁচ, নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগালের তিনজন ফুটবলার তাঁদের দেশকে ব্যালন ডি’অর এনে দিয়েছেন। মেসি একাই আর্জেন্টিনাকে গৌরবান্বিত করেছেন আটবার। মানে, মেসি এককভাবে চার দেশকেও পেছনে ফেলেছেন!