টেস্টে ১০ বছর পর ‘গোল্ডেন ডাক’ মেরেছেন স্টিভেন স্মিথ
টেস্টে ১০ বছর পর ‘গোল্ডেন ডাক’ মেরেছেন স্টিভেন স্মিথ

টেস্টের এমন দিন—৭৬.৪ ওভারে নেই ১৭ উইকেট, দুই দল মিলিয়ে রান মাত্র ২১৭

পার্থে আম্পায়াররা দিনের খেলা শেষ ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লাসিথ মালিঙ্গার ঘোষণা, ‘যশপ্রীত বুমরা বিশ্বসেরা।’

প্রথম দিনের খেলা শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে দিনের শেষ উইকেটটি নেন বুমরা। এবার শিকার অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। সব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে বুমরার চতুর্থ উইকেট। ভারতীয় পেসার কেমন বোলিং করেছেন সেটি বোঝা যায় ধারাভাষ্যকক্ষে মার্ক ওয়াহর কথায়। অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তির মনে হয়েছে, বুমরা তাঁর প্রতিটি ডেলিভারিতেই উইকেট পাবেন!

দিনের শেষ বলটাও তো সেরকমই ছিল, যেটা তিনি করেছিলেন মিচেল স্টার্ককে। সদ্যোজাত সন্তানের পাশে থাকার জন্য রোহিত শর্মা এখনো অস্ট্রেলিয়ায় যাননি বলে পার্থে আজ শুরু হওয়া বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির প্রথম টেস্টে ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক বুমরাই। শেষ বলটা করার আগে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফিল্ডিং সাজালেন। লেগ সাইডে নিলেন বাড়তি ফিল্ডার। যার মানে স্টার্ককে তিনি ইঙ্গিত দিলেন, শর্ট ডেলিভারি দেবেন।

কিন্তু হলো কী, বুমরা অফ সাইডে দিলেন স্লোয়ার। কিছুটা হতচকিত স্টার্ক রক্ষণ করতে গিয়ে দিলেন ফিরতি ক্যাচ। একটু সামনে পড়ায় সেটা অবশ্য নিতে পারেননি বুমরা। তাহলে তো ৫ উইকেট নিয়েই দিনের খেলা শেষ করতেন। সেটা হয়নি, কিন্তু বুমরার দুর্দান্ত বোলিংয়ে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৫০ রানে অলআউট হয়েও পার্থ টেস্টের প্রথম দিনটি ভারতের।

পার্থ টেস্টের প্রথম দিন ৪ উইকেট নিয়েছেন যশপ্রীত বুমরা

দুই দলের দুই ইনিংস মিলিয়ে প্রথম দিনে উইকেট পড়েছে মোট ১৭টি। কোন দল কত স্কোর করল, তাঁর চেয়ে সম্ভবত দুই দলের মোট ৭ পেসারের বোলিংয়েই বেশি আগ্রহ ছিল সবার। কারণ-গতি, সিম মুভমেন্ট, সুইং ও বাউন্সের মিশ্রণে টেস্টে দেখার মতো এক দিনই কাটল পার্থে। তবু আনুষ্ঠানিকতা বিচারে জানিয়ে রাখতেই হয়, ভারত প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানে অলআউট হওয়ার পর ৭ উইকেটে উইকেটে ৬৭ রানে দিনের খেলা শেষ করেছে অস্ট্রেলিয়া। সাতে নামা শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান অ্যালেক্স ক্যারির (১৯ *) সঙ্গে ক্রিজে আছেন নয়ে নামা মিচেল স্টার্ক (৯ *)।

এমন একটি আগুনঝরা বোলিংয়ের দিনে রেকর্ড হবে না, তা হতে পারে না। ১৯৫২ সালের পর গত ৭২ বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্টের প্রথম দিনে আজই প্রথমবারের মতো ১৭ উইকেটের পতন দেখা গেল। এমন পতনের দিনে প্রথম ঝড়টি গিয়েছে ভারতের ওপর দিয়ে। স্টার্ক-হ্যাজলউড-কামিন্স-মার্শদের যৌথ প্রযোজনায় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্টের প্রথম ইনিংসে নিজেদের ইতিহাসে যৌথভাবে সর্বনিম্ন স্কোরের ধাক্কা খেয়েছে ভারত। ২৪ বছর আগে সিডনি টেস্টে ম্যাকগ্রা-লি’দের তোপে পুড়ে প্রথম ইনিংসে এই ১৫০ রানেই অলআউট হয়েছিল সফরকারীরা।

চলতি বছর টেস্টে ভারতের ব্যাটিংও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এ বছর এই নিয়ে ৫ বার ১৬০ রানের নিচে অলআউট হলো ভারত। এক পঞ্জিকাবর্ষে ভারত ১৬০ রানের নিচে সর্বশেষ এর চেয়ে বেশিবার অলআউট হয়েছে ৬৫ বছর আগে।

ভারতের অলআউট হওয়ার প্রসঙ্গ ধরেই বলা যায়, আজ যে এমন কিছু হতে পারে সেটি আঁচ করা গিয়েছিল দিনের খেলার শুরুতেই। মিচেল স্টার্কের করা তৃতীয় ওভারে দিনের প্রথম আক্রমণাত্মক শটে (অন দ্য আপ ড্রাইভ) গালিতে ক্যাচ দেন যশস্বী জয়সোয়াল।

মাঝে ৭ ওভার পরই আরও একটি ক্যাচ, এবার হ্যাজলউডের শিকার দেবদূত পাড়িক্কাল, ক্যাচ গেল উইকেটকিপার ক্যারির গ্লাভসে। ধারাভাষ্যকার তখন বলে চলছেন, ‘ইউ ডোন্ট ড্রাইভ অন দ্যাট লেংথ ইন পার্থ।’ কারণ? বল উঠছিল বেশ। ড্রাইভ করার লেংথ কিংবা আরেকটু পেছনে পড়া বল দেখে লোভাতুর হতে গেলেই সর্বনাশ!

বিরাট কোহলিকে দ্রুতই ফিরিয়েছেন জশ হ্যাজলউড

অস্ট্রেলিয়ার এই ভালো শুরুর মধ্যেই অপ্টাস স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ততক্ষণে হাজার পঁচিশেক দর্শক জমে গেছে। তাঁরা নিশ্চয়ই মর্মে মর্মে ‘উপভোগ’ করেছেন ভারতের এবারের সফরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানুষটির আউট। বিরাট কোহলি! মাত্র ১২ বলে ৫ রান করা কোহলিকে একটুর জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দেখা যায়নি।

হ্যাজলউডের তেমনই এক অস্বস্তিকর বাউন্সে ‘ছাড়ব না খেলব’ দ্বিধায় ভুগে শেষ মুহূর্তে ব্যাট ছুঁইয়ে বল প্রথম স্লিপে পাঠিয়ে ফেরেন কোহলি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন রসিকতার রোল উঠেছে, কোহলি যত রান করলেন, তাঁকে নিয়ে তাঁর বেশি আর্টিকেল লেখা হয়েছে!

লাঞ্চের বিরতির আগে লোকেশ রাহুলের আউটটি নিয়ে এক পশলা বিতর্কও হয়েছে। বল ব্যাটে লেগেছিল কি না, তা নিয়ে। অস্ট্রেলিয়া রিভিউ নিয়ে তাঁকে ফেরালেও মুখে অসন্তোষের ছাপটা হয়তো গ্যালারির দূরতম জায়গা থেকেও বোঝা গেছে। ৪ উইকেটে ৫১ রানে ভারত লাঞ্চ থেকে ফেরার পর এই ইনিংসের গল্পের বাকিটাও গড়িয়েছে একই পথে। শুধু ঋষভ পন্ত ও নীতিশ রেড্ডি ষষ্ঠ উইকেটে ৮৫ বলে ৪৮ রানের জুটিতে বিপরীত স্রোতের নায়ক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। ৩৭ রান করা পন্ত ও ৪১ করা নীতিশ ওই সময় না দাঁড়ালে ভারতের ইনিংস হয়তো এক শও পার হতো না!

লোকেশ রাহুলের আউট নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে

যেমনটা মনে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসেও। ভারতের মতোই তৃতীয় ওভারে ফিরেছেন অভিষিক্ত নাথান ম্যাকসোয়েনি। এলবিডব্লু এবং বোলার? কে আবার, বুমরা! নিজের প্রথম ৬ ওভারের স্পেলে আরও ২টি উইকেট নিয়েছেন বুমরা। সেটাও হ্যাটট্রিকের সুযোগ তৈরি করে! ষষ্ঠ ওভারের চতুর্থ বলে স্লিপে তাঁর শিকার উসমান খাজা। পরের বলে স্কিড করানো দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে এলবিডব্লু স্টিভ স্মিথ। গোল্ডেন ডাক! স্মিথের জন্য বিরল অভিজ্ঞতাই। ১০ বছর পর টেস্টে তাঁর গোল্ডেন ডাক।

বুমরাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন দুই পেসার মোহাম্মদ সিরাজ ও অভিষিক্ত হর্ষিত রানা। ১৩ বল খেলার মধ্যেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেওয়া ট্রাভিস হেডকে দারুণ ডেলিভারিতে বোল্ড করেন হর্ষিত।

মাঝে তিন ওভারের বিরতিতে মারনাস লাবুশেন ও মিচেল মার্শকে ফিরিয়েছেন সিরাজ। তৃতীয় স্লিপে মার্শের যে ক্যাচটি লোকেশ রাহুল নিয়েছেন সেটি যে কারও জন্যই লোভনীয়। কোহলির হিংসা হতে পারে সবচেয়ে বেশি। তিনি যে লাবুশেনের ক্যাচ ছেড়েছেন স্লিপে। দিনটা মোটেও ভালো যায়নি তাঁর।

টেস্ট অভিষেকে ট্রাভিস হেডকে বোল্ড করেছেন হর্ষিত রানা

কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের দর্শকদের জন্য এমন দিনই তো কাঙ্ক্ষিত। আগুন (পেস) ও পানির (ডিফেন্স) এই দিনে আপাতত জয়টা হলো আগুনেরই!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ভারত প্রথম ইনিংস: ৪৯.৪ ওভারে ১৫০ (নীতিশ ৪১, পন্ত ৩৭, রাহুল ২৬, জুরেল ১১; হ্যাজলউড ৪/২৯, মার্শ ২/১২, স্টার্ক ২/১৪, কামিন্স ২/৬৭)।

অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ২৭ ওভারে ৬৭ / ৭ (ক্যারি ১৯ *, হেড ১১, ম্যাকসোয়েনি ১০; বুমরা ৪/১৭, সিরাজ ২/১৭)।

(প্রথম দিন শেষে)