পুরো অ্যাডিলেড ওভালই বিস্মিত। মাঠে সাকিব আল হাসানের বিস্ময়, সেই বিস্ময় ছড়িয়েছে ধারাভাষ্যকক্ষ এবং প্রেসবক্সেও। পাকিস্তানের ডাগআউটই-বা আর বাকি থাকবে কেন! সাকিবের বিতর্কিত এলবিডব্লু বিস্ময় জাগিয়েছে সেখানেও।
বাংলাদেশ দল সূত্রে জানা গেছে, শাদাব খানের বলে ভুল এলবিডব্লুর শিকার হয়ে সাকিব মাঠ থেকে উঠে আসার পর ডাগআউটে থাকা পাকিস্তান দলের সদস্যরাও তাঁকে ডেকে বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্য, ওটা আউট ছিল না।’ তাঁদের এ কথা সাকিবের জন্য কতটুকু সান্ত্বনা হয়েছে, কে জানে, তবে জিম্বাবুয়ের টেলিভিশন আম্পায়ার ল্যাংটন রুসেরের সিদ্ধান্তটা যে অ্যাডিলেড ওভালের প্রতিটি কোনায় বিস্ময় ছড়িয়ে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সৌম্য সরকার আউট হওয়ার পর উইকেটে এসে লেগ স্পিনার শাদাবের প্রথম বলটাই ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু ঠিকভাবে খেলতে পারলেন না, বল তাঁর বুট ছুঁয়ে চলে যায়। পাকিস্তানের বোলার-ফিল্ডারদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আম্পায়ার অ্যাড্রিয়ান হোল্ডস্টক এলবিডব্লু দিয়ে দেন সাকিবকে।
সাকিব সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নেন। মাঠে তাঁর শরীরী ভাষাও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন এলবিডব্লু হননি। টেলিভিশন রিপ্লেতেও পরিষ্কার দেখা গেছে, শাদাবের বল সাকিবের ব্যাট ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ সময় নেওয়ার পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে টিভি আম্পায়ার রুসেরে ফিল্ড আম্পায়ারের এলবিডব্লুর সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন।
বিস্মিত সাকিব দুহাত তুলে জানতে চাইলেন, কী হলো এটা! কিন্তু এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও কেউ ভুল আউট দিলে আর কীই–বা করার থাকে! সাকিব নিশ্চিত ছিলেন বল তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে তবেই বুটে লেগেছে। ওদিকে আম্পায়ারের মনে হয়েছে বল ব্যাটে লাগেনি, সরাসরি বুটে লেগেছে। আলট্রা এজে যেটা দেখা গেছে, সেটা নাকি ব্যাট এবং মাটির সংঘর্ষ!
যদিও পরে টিভি রিপ্লেতে পরিষ্কার হয়েছে, সাকিবের ব্যাট মাটির বেশ ওপরে ছিল। আম্পায়ারদের এমন ভুলের পর অসহায় সাকিবের ডাগআউটে ফিরে আসা ছাড়া কিছু করার ছিল না।
রুসেরের সিদ্ধান্ত অবাক করেছে প্রেসবক্সে থাকা পাকিস্তানের সাংবাদিকদেরও। তাঁদের মধ্যে বর্ষীয়ান এক সাংবাদিক তো বলেই বসলেন, ‘এই আম্পায়ার কিন্তু কদিন পরপরই ভুল করেন।’ আসলেই তা–ই। এই বিশ্বকাপেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের সময় একটা ওভার ৫ বলে শেষ করে দিয়েছেন তিনি ও পাকিস্তানের আম্পায়ার আলিম দার। রুসেরের ভুল করার নজির আছে অতীতেও।
সাকিবের আউট দেখে ধারাভাষ্যকক্ষেও বিস্ময়ের স্রোত বয়ে গেছে। বাংলাদেশের ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান তো অন এয়ারেই বলে দিয়েছেন, ব্যাটের সঙ্গে বলের সংঘর্ষটাই ধরা পড়েছে আলট্রা এজে। ব্যাট ক্রিজের অনেক ওপরে ছিল। তিনি বুঝতে পারছেন না কেন সাকিবকে আউট দেওয়া হলো!
ধারাভাষ্যকক্ষে তখন ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক উইকেটকিপার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ইয়ান স্মিথ, কার্ল হুপার, ড্যানি মরিসনসহ আরও কয়েকজন। প্রথম আলোকে আতহার বলছিলেন, ‘সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। এটা কীভাবে আউট হয়!’
দক্ষিণ আফ্রিকার দুই সাবেক ক্রিকেটার শন পোলক আর ডেল স্টেইন ওই সময় ধারাভাষ্যকক্ষে ছিলেন না। তবে একটু পর সেখানে এসে তাঁরাও বিস্ময়ই প্রকাশ করেছেন। কারও মাথায়ই আসছিল না বল ব্যাট ছুঁয়ে যাওয়ার পরও কীভাবে এলবিডব্লু হলেন সাকিব! গিলক্রিস্ট পরে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকেও বলেছেন, সাকিবের আউটটা ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
বাইরের সবাই আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের এতটা সমালোচনা করলেও আইসিসির আচরণবিধির কারণে ক্রিকেটারদের এ নিয়ে খুব বেশি মুখ খোলার সুযোগ নেই। যে কারণে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের পরও আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গিয়েছিলেন সাকিব। গতকাল তো তিনি সংবাদ সম্মেলনেই এলেন না।
যিনি এসেছেন, সেই নাজমুল হোসেনও খুব অল্প কথায়ই শেষ করেছেন প্রসঙ্গটা, ‘আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ওটা আউট (সাকিব) হয়নি। কিন্তু সিদ্ধান্ত আম্পায়ারের, এর ওপর কিছু বলার নেই। এগুলো নিয়ে আলোচনা করে আসলে লাভ নেই। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণেও নেই। আমরা যতই আলোচনা করি, কথা বলি; কোনো লাভ নেই।’
সাকিবের আউটকে হারের অজুহাত হিসেবেও দাঁড় করাননি নাজমুল। পরে মিক্সড জোনে ব্যাটসম্যান আফিফ হোসেনও সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন বিষয়টি। তবে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল ব্রডকাস্টার জিটিভির সঙ্গে কথা বলার সময় ক্ষোভ গোপন করেননি পেসার ইবাদত হোসেন, ‘এ রকম একটা আউট মেনে নেওয়ার মতো নয়। শেষ ম্যাচেও ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে, অনেকগুলোই আমাদের বিপক্ষে গেছে। এমন সিদ্ধান্ত যদি প্রতি ম্যাচে হয় তাহলে আমাদের মতো দলের ফিরে আসা কঠিন। সাকিব ভাই আমাদের অন্যতম অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। ওনার এমন আউট আমাদের জন্য বড় ক্ষতি।’
ইবাদতের বিশ্বাস, সাকিব উইকেটে থাকলে হয়তো বাংলাদেশের পরের উইকেটগুলোও পড়ত না। ‘ওনার উইকেটের পরই কিন্তু আরও দুটি উইকেট পড়ে গেছে। উনি যদি উইকেটে থাকতেন, সিদ্ধান্তটা আমাদের পক্ষে এলে তো বাকি উইকেটগুলো পড়ত না। আম্পায়ার দেখেও দেখছে না। দেখেও ভুল করছে’—বলেছেন ইবাদত।
এতজন এত কথা বললেন, কিন্তু সাকিবের বিতর্কিত আউট নিয়ে পাওয়া যায়নি সাকিবের বক্তব্যই। অবশ্য কীই–বা বলবেন সাকিব। বিস্ময়ের ধাক্কাটা তো তাঁরই মনেই লেগেছে সবচেয়ে বেশি।