দক্ষিণ আফ্রিকার দুঃখরজনী তাহলে শেষ হলো অবশেষে। সেটিও কী অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায়! ত্রিনিদাদের রাতকে আফগানিস্তানের দুঃখরজনী বানিয়ে।
সেই ১৯৯২ সালে প্রথম বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু করে সেমিফাইনালের পর সেমিফাইনাল। দল বদলেছে, মাঠ বদলেছে, বদলেছে প্রতিপক্ষও। একটা জিনিসই শুধু বদলায়নি—সেমিফাইনাল মানেই দক্ষিণ আফ্রিকার পরাজয়। ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাঁচবার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুই—সাত সাতটি সেমিফাইনাল থেকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। কখনো দুর্ভাগ্যকে দুষেছে, কখনো-বা মেনে নিতে হয়েছে ‘চোকার্স’ অপবাদ, কখনো হয়তো নিজেরাই ভেবেছে, ফাইনাল আর খেলা হবে না কোনো দিন।
সাতবারে যা হয়নি, অষ্টমবারে তা হলো ইতিহাসের সবচেয়ে একতরফা বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আফগানিস্তানকে উড়িয়ে দিয়ে। এমন এক ম্যাচ, এক ইনিংস শেষেই যেটির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলা যায়। ক্রিকেটে অনেক আশ্চর্যই ঘটে। তাই বলে ৫৬ রান করেও আফগানিস্তান জিতে যাবে—এতটা আশ্চর্য খেলা ক্রিকেট নয়।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এর চেয়ে কম রানেরও তিনটি স্কোর আছে। তবে তার কোনোটিই সেমিফাইনালে নয়। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল তো এক শ রানের কম স্কোরই দেখেনি এর আগে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির নকআউট যেকোনো ম্যাচেই এটি সর্বনিম্ন স্কোর। আফগানিস্তানও কিনা টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে কম রানে আউট হয়ে যাওয়ার দিন হিসেবে বেছে নিল এটিকেই।
টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়াটাই কি কাল হলো তাহলে? দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের সময়ও উইকেট ভীষণ জীবন্ত। নাভিন-উল হক আর ফজলহক ফারুকি বুঝিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমে ব্যাটিং করতে হলে তাদের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার হতো না। পেস-বাউন্স-মুভমেন্ট মিলিয়ে পেসারদের জন্য স্বপ্নের এক উইকেট। ইয়ানসেন-রাবাদা-নর্কিয়ার প্রলয়নৃত্য দেখতে দেখতে এইডেন মার্করাম নিশ্চয়ই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফেলেছেন, ভাগ্যিস, টসটা হেরেছিলাম। টসে জিতলে তিনিও তো প্রথমে ব্যাটিং করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন।
আফগানিস্তানের অমন ধসে পড়ায় উইকেটের অবশ্যই বড় ভূমিকা; সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকানদের দুর্দান্ত বোলিংয়েরও। অদৃশ্য আরেকটা কারণও কি আছে? সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওই উথালপাতাল ম্যাচে জয় পাওয়ার পর আবেগের যে স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আফগানদের, তা থেকে ঠিকমতো থিতু হওয়ার সময়ই পায়নি এই ম্যাচের আগে। রাত ১টারও পরে শেষ হয়েছে ম্যাচ। হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত ৩টা। সকাল ৮টায়ই আবার সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে ত্রিনিদাদের ফ্লাইট। বলতে গেলে একটা দিনও বিশ্রাম না পেয়েই আবার নেমে পড়তে হয়েছে মাঠে। যেটি আবার আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ম্যাচ। বিশ্বকাপে প্রথম সেমিফাইনাল।
আবেগের ওই উচ্চতা থেকে নেমে এসে সুস্থির চিন্তা করার মতো সময় আফগানিস্তান পেল কোথায়! তার ওপর আবার এমন উইকেটে ব্যাটিং। বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিংয়েই মানসিক অবস্থা বেশি প্রভাব ফেলে। প্রথমে বোলিং করলে কে জানে, আফগানিস্তান নিজেদের একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় পেত কি না!
কিন্তু রশিদ খান কেনই-বা তা করতে যাবেন! এই বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বড় জয়ের সব কটিই প্রথমে ব্যাটিং করে। যে ব্যাটিংয়ে আবার দুই ওপেনারের পর বলতে গেলে কিছুই নেই। সেমিফাইনালের আগে গুরবাজ-জাদরানের উদ্বোধনী জুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ৪৪২ রান তুলে ফেলেছে। আফগানিস্তানের বাকি সব জুটি মিলে মোট রান যেখানে ৫২১। পরের ব্যাটসম্যানদের এই দুর্দশার পরও রশিদ খান কীভাবে রান তাড়া করার সিদ্ধান্ত নেবেন? তার ওপর যেখানে জানেন, বোলিংটাই তাঁর দলের মূল শক্তি। মোটামুটি একটা রান স্কোরবোর্ডে তুলতে পারলেই সুযোগ থাকবে। আর ‘সি’ আদ্যক্ষরের যে শব্দটা এত বছর তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে, তা তো রান তাড়ার সময়ই বেশি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
কিন্তু আফগান বোলাররা তো লড়াই করার মতো কোনো পুঁজিই পেলেন না। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই এক টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৪টি ৫০ রানের জুটি গড়েছেন গুরবাজ-জাদরান। এদিন যাঁদের প্রথম ওভারেই বিচ্ছেদ। শূন্য রানে গুরবাজকে তুলে নিলেন ইয়ানসেন। রাবাদার প্রথম বলেই জাদরান। সেই ওভারেই মোহাম্মদ নবীকেও তুলে নিয়ে রাবাদার ডাবল উইকেট মেডেন। এরপর যা হলো, তা নির্ভেজাল ধ্বংসযজ্ঞ। আফগান ব্যাটসম্যানরা যাচ্ছেন আর আসছেন। ডাগআউটে ফিরে আসার এমনই প্রতিযোগিতা যে একটা সময় উইকেট পড়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকানদের উদ্যাপন পর্যন্ত একটু স্তিমিত! এত ঘন ঘন উদযাপন করলে কী আর সেটির তীব্রতা থাকে! মাঝখানে যে বিরতিই পড়ছে না!
টেলিফোন নাম্বারের মতো এক স্কোরকার্ড, যাতে সর্বোচ্চ স্কোর আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের। কোনোমতে দুই অঙ্ক ছোঁয়া আফগানিস্তানের একমাত্র ব্যাটসম্যান। না, ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোর ওমরজাইয়ের নয়। তাঁর চেয়ে ৩ রান বেশি মিস্টার এক্সট্রার। ওমরজাই ১০, অতিরিক্ত ১৩।
ব্রায়ান লারার নামাঙ্কিত এই স্টেডিয়াম পোর্ট অব স্পেন থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। মাঠমুখী গাড়ির স্রোতে শহর থেকে যেখানে আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা। এমন সাজানো-গোছানো সুন্দর এক স্টেডিয়াম যে সেই বিরক্তি মুহূর্তেই উধাও। যে সেমিফাইনাল নিয়ে পোর্ট অব স্পেনে বিন্দুমাত্র উত্তাপ টের পাওয়া যায়নি, সেটিকে ঘিরেই রীতিমতো উৎসব চলছে স্টেডিয়ামের বাইরে। ড্রাম বাজছে। রংবেরঙের পোশাক পরা তরুণ-তরুণী রণপায়ে চড়ে নেচে যাচ্ছেন। বিরাট একটা ভ্যানে বড় বড় সাউন্ডবক্সে একের পর এক এক গান বাজিয়ে যাচ্ছেন ডিজে। খেলা শুরু হওয়ার পর সেই উৎসব স্থানান্তরিত গ্যালারিতে। উচ্চ স্বরে মিউজিক বাজছে, তার তালে তালে নাচছেন দর্শক। এমন আনগ্ল্যামারাস সেমিফাইনাল বিবেচনায় সংখ্যাটা খারাপ নয়।
ম্যাচ শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরও সেই গান বেজে যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকানদের কানে যা খুবই মধুর লাগছে। আফগানিস্তানের কাছে হয়তো অসহ্য। কিন্তু গান থামবে কেন? ম্যাচ যখন শেষ, তখন তো আসলে প্রথম ইনিংস শেষ হওয়ার কথা!