ইংল্যান্ডের বিশেষ এক জয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন জেমস অ্যান্ডারসন
ইংল্যান্ডের বিশেষ এক জয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন জেমস অ্যান্ডারসন

ইংল্যান্ডের যে ম্যাচটি অ্যান্ডারসনের, টেস্ট ক্রিকেটেরও

জেমস অ্যান্ডারসন ক্যারিয়ারে এর আগে খেলেছেন ১৭৫টি টেস্ট। অ্যান্ডারসনের টেস্ট ক্যারিয়ারের সময়ে যুক্তরাজ্য দেখেছে সাতজন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৩ সালে অভিষেকের সময় তাঁর অধিনায়ক ছিলেন নাসের হুসেইন, ক্যারিয়ারে অ্যান্ডারসন এখন পর্যন্ত খেলেছেন আটজন ভিন্ন অধিনায়কের অধীনে। এর আগে তিনি অংশ ছিলেন ইংল্যান্ডের ৭৮টি টেস্ট জয়ে। সেই অ্যান্ডারসনের কাছে এ জয়টা সেরার তালিকায় সবার ওপরে না হলেও অন্যতম সেরা হয়ে থাকবে। বেন স্টোকসকে তিনি বলেছেন, ক্যারিয়ারে এমন আবেগপূর্ণ জয় আসেনি তাঁর।

অ্যান্ডারসন—টেস্ট ক্রিকেটে যুগের সাক্ষী হয়ে এখনো যিনি ওই সাদা পোশাক গায়ে জড়ান, লাল (বা গোলাপি) বলটা হাতে নেন। তাঁর মতো কেউ যখন অধিনায়ককে বলেন, এ জয় বিশেষ কিছু, তখন আপনি বুঝে নেবেন রাওয়ালপিন্ডিতে বিশেষ কিছুই করেছে স্টোকস ও ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ইংল্যান্ড।

****

টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা অনেকটাই বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে আলোচনার মতো। আপনি হয়তো জানেন এর মাহাত্ম্য কতটা, কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনার বাস্তবিক প্রয়োগ ঠিক নজরে আসে না। একটি করে নতুন সংস্করণ আসে, টেস্ট ক্রিকেটের ওপর চাপ আরেকটু বাড়ে। একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগগুলো ক্রিকেটের কাঠামো বদলে দিচ্ছে, সেই লিগগুলোর ওপর ভিত্তি করে যে নতুন ক্রিকেট-পৃথিবী তৈরি হবে, তাতে টেস্টের (বা ওয়ানডেরও) অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই চিন্তার বিষয়।

টেস্ট ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নিতে আপনি যা চাইবেন না, তা হচ্ছে রাওয়ালপিন্ডির মতো উইকেট। যে পিচ নিয়ে খোদ পিসিবি চেয়ারম্যানই বলেন, ব্যাপারটি তাঁদের জন্য লজ্জার। এ টেস্টে হয়েছে ১৭৬৮ রান—‘টাইমলেস টেস্ট’ ছাড়া যেটি এক ম্যাচে সর্বোচ্চ। ক্রিকভিজের ডেটা অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বল-বাই-বল রেকর্ড রাখা শুরুর পর থেকে ব্যাটসম্যানদের ফলস শটের (মানে যেখানে ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক হয় না) যে শতকরা হার, সেটি এ ম্যাচের চেয়ে কম আছে মাত্র ৪৩টি। এ সময়ে হয়েছে প্রায় ৭০০টি টেস্ট। এমন ব্যাটিং-প্রসন্ন উইকেটে ব্যাট-বলের লড়াইটা তাই হয়ে ওঠার কথা একতরফা, খানিকটা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের মতো। আইসিসির ম্যাচ রেফারির নোটবুকে এ টেস্টের উইকেটের পাশে থাকার কথা গাঢ় লাল দাগ।

স্টোকসরা জানতেন, এ পিচে সবচেয়ে বড় মূল্যবান হয়ে উঠবে সময়। ব্যাটসম্যানরা ভুল না করলে এখানে উইকেট মিলবে না সেভাবে। সময় বাঁচাতে দরকার তাই দ্রুত রান তোলা। টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পরই তাই নিজেদের কাজটা জানতেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। প্রথম দিনে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড, ইনিংসে সবচেয়ে বেশি হারে রানের রেকর্ড ইঙ্গিত দিচ্ছিল সেটিই। তবে ঝামেলা হলো, শুধু দ্রুত রান তুললে হবে না, সময়ের সঙ্গে লড়াইটা জিততে হলে নিতে হবে দ্রুত উইকেটও।

পাকিস্তানের বোলিং লাইনআপ অনভিজ্ঞ হতে পারে, তবে ব্যাটিং পূর্ণ শক্তিরই। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তান যতক্ষণে অলআউট হলো, টেস্টে চার দিনের বেশি পেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড তাই খেলল মাত্র ৩৫.৫ ওভার। প্রথম ইনিংসে ৬৫৭ রান তোলা দলটা প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য দিল মাত্র ৩৪৩ রানের, টেস্টে তখনো বাকি চার সেশন।

সীমিত ওভারের পর এবার টেস্ট ক্রিকেটকে বদলে দিচ্ছে ইংল্যান্ড?

সাধারণত ইনিংস ঘোষণার সময় অধিনায়কেরা ভাবেন, অন্তত একটি কার্ড যাতে তাঁর হাতে থাকে। প্রতিপক্ষ লক্ষ্য তাড়া করতে গেলে করতে হবে অভাবনীয় কিছু, অথবা ড্র করতে গেলে খেলতে হবে অনেকটা সময়। সর্বশেষ পাকিস্তান সফরে অস্ট্রেলিয়া বাবর আজমদের দিয়েছিল ৫০৬ রানের লক্ষ্য, ১৭১.৪ ওভার ব্যাটিং করে সে টেস্ট ড্র করেছিল স্বাগতিকেরা। স্টোকস যে সময় ইনিংস ঘোষণা করলেন, তাতে যেন খেলে দিলেন সব কার্ডই। লক্ষ্যটা নাগালে, পাকিস্তান প্রলুব্ধ না হয়ে পারে না। স্টোকস সেটিই চেয়েছিলেন। পাকিস্তান ব্যাটসম্যানরা প্রলুব্ধ হোন, শট খেলতে যান, তাতে ভুল করুন।

কারণ ড্র শব্দটা নিজেদের অভিধানে রাখতে চান না তাঁরা। স্টোকস ইনিংস ঘোষণার পর ইংল্যান্ড ক্রিকেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘোষণা দিল, ‘জেতার জন্য এসেছি, বিনোদন দিতে এসেছি।’

****

শুধু ‘জেতার জন্য এসেছি’ বলা এক কথা, আর সেটির প্রয়োগ আরেক কথা। ব্যাটিংয়ের জন্য এমন মোলায়েম উইকেট, যেখানে সিম-সুইং নেই, স্পিনের দেখা মিলছে না অনেকটা সময়, তাতে বোলারদের একটা অস্ত্র হতে পারে গতি। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের নাসিম শাহ দেখিয়েছেন সেটি। কিন্তু ইংল্যান্ডের তিন পেসারের কারোরই সেটি নেই। ওলি রবিনসনের বয়স ২৯, তবে অতীতে তাঁর ফিটনেসের পাশে বড়সড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্নই ছিল। অ্যান্ডারসন পেরিয়ে গেছেন ৪০। দুজনই ইংলিশ কন্ডিশনে উপযুক্ত, এমন ফ্ল্যাট উইকেটে তাঁদের কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা থাকতেই পারে। স্টোকস ইচ্ছাশক্তিতে ভরপুর, অবিশ্বাস্য দীর্ঘ স্পেলও করতে পারেন। তবে আপনি জানেন, অতিমানবেরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

এমন পরিস্থিতিতে দরকার উদ্ভাবনী কিছু। ডানহাতি জো রুট এর আগে ব্যাটিং করেছিলেন বাঁ হাতে, বলের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে সহায়তা নিয়েছিলেন জ্যাক লিচের ‘টেকো’ মাথার। এবার তাঁর পরামর্শেই এল নতুন বলে শর্ট ডেলিভারির কৌশল। এ উইকেটে বাউন্সও সেভাবে নেই, ফলে শর্ট বলে সাফল্যের সম্ভাবনা একটু হলেও বাড়বে নতুন ও শক্ত বলে। চতুর্থ দিন ইংল্যান্ড পেল প্রথম ইনিংসে দুই সেঞ্চুরিয়ানের উইকেট—দুটিই শর্ট বলে। সঙ্গে চোট পেয়ে উঠে গেলেন আজহার আলী। সেদিন পাকিস্তান রান তুলল ওভারপ্রতি ৪ করে। শেষ দিন ৮০ ওভার খেলা হলেও পাকিস্তানের জয়ের জন্য ওভারপ্রতি করতে হতো ৩.৫০-এর কম করে।

যে উইকেটে একতরফা লড়াইটা হওয়ার কথা ছিল লজ্জার, সেটিই হাতছানি দিচ্ছিল রোমাঞ্চের। রাওয়ালপিন্ডিতে সে রোমাঞ্চের আশায় ছুটে আসা দর্শকেরা শেষ দিন প্রায় ভরিয়ে তুললেন গ্যালারি। পাকিস্তান এরপর শুরু করল প্রতি-আক্রমণ। হার্শা ভোগলে টুইট করলেন, ‘আমরা কি তবে সেই অসম্ভব পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছি, যখন কোনো দল প্রথম ইনিংসে ৬৫৭ রান করেও হারে?’

স্টোকসরা অবশ্য বরাবরই বলে এসেছেন, সে ভয়টা রাখতে চান না তাঁরা মনে। ৬৫৭ রান করে হারলেও তাদের কিছু যায়–আসে না।

****

অ্যান্ডারসন সহায়ক কন্ডিশন ছাড়া কিছু করতে পারেন না, সমালোচকেরা এমন বলার চেষ্টা করেন। তবে ৪০ পেরোনো বয়সে যিনি বিদেশের মাটিতে পেস বোলিংয়ের সাহস দেখাতে পারেন, তাঁর কিছু না কিছু তো আছেই। সেই সামর্থ্যের অন্যতম বড় একটি ডিসিপ্লিন—স্কেলমাপা বোলিং। আর আছে রিভার্স সুইং। যে রিভার্স সুইংয়ের পেটেন্ট করার কথা উঠলে সবচেয়ে বড় দাবিদার হবে পাকিস্তান, সেই তাদের বিপক্ষেই অ্যান্ডারসন-রবিনসন-স্টোকসরা বের করে আনলেন ক্রিকেটের একসময়ের কালো ওই জাদু।

৪০ পেরোনো বয়সে যিনি বিদেশের মাটিতে পেস বোলিংয়ের সাহস দেখাতে পারেন, তাঁর কিছু না কিছু তো আছেই

ইংল্যান্ডের দেওয়া লক্ষ্যে প্রলুব্ধ হয়ে ছুটতে থাকা পাকিস্তান জয়টা দেখছিলও একসময়। সেটিই বদলে গেল তাতে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তখন ড্র, যার মানে খোলসে ঢুকে যাওয়া। যার মানে বোলারদের আক্রমণের সুযোগ, যখন টেলিভিশনের এক ফ্রেমেই সব ফিল্ডার এঁটে যাবেন। স্টোকস অবশ্য এখানেও দেখালেন উদ্ভাবনী কিছু, স্লিপ কর্ডনটাই যেন উঠে এল কাভারে।

তবে টেস্ট জিততে গেলে আপনার ২০ উইকেট দরকার, ইংল্যান্ডের তখনো নেওয়ার বাকি একটি। নাসিম শাহর স্টাম্পে লেগে বল বেরিয়ে গেল, বেলস পড়ল না। বাজিদ খান ধারাভাষ্যে বলে উঠলেন, ‘আম্পায়ার্স কল’। উইকেটকিপার ওলি পোপ ও প্রথম স্লিপে থাকা জো রুট এরপর একে অন্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকলেন, নাসিমের ব্যাটে লেগে বেরিয়ে যাওয়া বলটা তাঁদের অপেক্ষা না করে ছুটে বেরিয়ে গেল। রাওয়ালপিন্ডিতে তার আগেই কমে আসতে শুরু করেছে আলো। একটু পরপর টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখানো হচ্ছে সেই পুরোনো ঘড়িটা।

ইসা গুহ টুইট করলেন, ‘এমন একটা পিচেও লোকে শেষ দুই সেশনে কী হচ্ছে, তা দেখা বা শোনার জন্য মরিয়া। নিশ্চিতভাবেই, সবকিছু তো এ জন্যই।’

তবে স্টোকস জানেন, একটু পরই আম্পায়াররা পেসারদের দিয়ে আর বল করতে দেবেন না। একটু পরই সূর্যটা চলে যাবে আড়ালে, সেই সঙ্গে যাবে জয়ের আশাও। জ্যাক লিচের হাতে নতুন বলটা তুলে দিলেন।

অধিনায়কত্ব নেওয়ার পর স্টোকস বারবারই বলে এসেছেন, ইংল্যান্ডের খেলা যাতে হয় রোমাঞ্চের। পঞ্চম দিন দুটি ফল মাথায় নিয়েই মাঠে এসেছিলেন তাঁরা, তবে সে দুটির মধ্যে ড্র ছিল না। অবশ্য ড্র-ই তখন পাকিস্তানের কাছে জয়ের সমান।

****

এতক্ষণ অন্তত দুবার বেঁচে যাওয়া নাসিমের ব্যাট ফাঁকি দিল জ্যাক লিচের বলটা। জোয়েল উইলসন আঙুল তুলতে সময় নিলেন না। এর আগে এ নিচু বাউন্সের উইকেটেই আগা সালমান রিভিউ নিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন বল ট্র্যাকিংয়ে বাউন্সের কারণে উইকেট মিস করে যাওয়ায়। তবে রাওয়ালপিন্ডির সবাই তখন জানেন, নাসিমের রিভিউটা আনুষ্ঠানিকতা।

‘জেতার জন্য এসেছি, বিনোদন দিতে এসেছি।’

এখন পর্যন্ত ৯ ম্যাচ অধিনায়কত্ব করেছেন স্টোকস, ডেটা হিসেবে এ সেটটা খুব বড় নয়। তবে কমপক্ষে ৯ টেস্টে এখন পর্যন্ত আর একজন অধিনায়কেরই জয়ের শতকরা হার তাঁর চেয়ে বেশি। এই ইংল্যান্ডের চেয়ে আর কোনো দলই এত বেশি রান ওভারপ্রতি তোলেনি। মাত্র ১১টি দলের উইকেট নেওয়ার স্ট্রাইক রেট স্টোকসের ইংল্যান্ডের চেয়ে বেশি।
হার্শা ভোগলে টুইট করলেন, তিনি ইংল্যান্ডের এই টেস্ট খেলার ধরনের মুগ্ধ। একটু পর ধন্যবাদ জানালেন স্টোকস ও ম্যাককালামকে। কারণ, তাঁরা ‘আমাদের এই খেলার জন্য অনেক কিছু’। ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য কাতারে থাকা গ্যারি লিনেকার বললেন, জয়টা শুধু ইংল্যান্ডের নয়, ক্রিকেটেরও। টুইটার আরেকবার সরব হলো ইংল্যান্ড নিয়ে, টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে।

লিচের বলে নাসিমের এলবিডব্লিউর রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত এসেছে তার আগেই। তবে উইলসন যখন প্রথমবার আঙুল তুললেন, তখন খুব দ্রুত বদলাতে থাকা টেলিভিশন ফ্রেমগুলোর একটিতে দেখা যায়, লেগ স্লিপে থাকা অ্যান্ডারসন উদ্‌যাপন করছেন দুই হাত তুলে। যেন উইকেটটা তিনি পেয়েছেন।

ক্যারিয়ারে্র ১৭৬তম ম্যাচে পাওয়া ৭৯তম জয়টি অ্যান্ডারসনের কাছে আবেগময়। ইংল্যান্ডের এ ম্যাচটি অ্যান্ডারসনের। এ ম্যাচটি টেস্ট ক্রিকেটের।