হতে পারে ক্রিকেট একটা খেলা, আফগানিস্তান সিরিজ আর দশটা আন্তর্জাতিক সিরিজের মতোই একটা সিরিজ। কিন্তু খেলার মাঠের সমস্যা সমাধানে যখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়কেও জড়িয়ে যেতে হয়, বুঝে নিতে হবে, খেলার মাঠের লোকেরা হয়তো নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারছেন না।
‘খেলার মাঠ’ বলতে শুধু স্টেডিয়ামের সবুজ চত্বর বোঝানো হচ্ছে না, খেলার জগৎটাই তো একটা মাঠ! এই যে চট্টগ্রামে প্রথম ওয়ানডের আগে তামিম বলে দিলেন, তিনি পুরোপুরি ফিট নন, প্রথম ম্যাচ খেলে বুঝবেন ফিটনেসের অবস্থা। তারপর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বাজখাঁই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যারপরনাই আক্রমণাত্মক ভাষায় তামিমকে সমালোচনার শূলে বিদ্ধ করলেন।
জবাবে পরশু সংবাদ সম্মেলন করে তামিম যে কান্নাভেজা কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, খেলাটাই আর খেলবেন না—‘গুডবাই’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট; বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসবই যেন খেলার অংশ হয়ে গেছে।
অথচ খেলার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এসব আসলে বেঠিক সংস্কৃতিরই উদাহরণ। এ রকম পরিস্থিতিতে যখন যেটা ঘটলে পরিস্থিতি যেকোনো পর্যায়ে স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারত, তখন সেটা না ঘটে ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে উল্টোটা, মানে বেঠিকটা।
তা সঠিক হতো কোনটি?
সঠিক হতো, যদি অধিনায়ক হয়েও ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে ‘আনফিট’ ঘোষণা না করতেন তামিম। ম্যাচ খেলে ফিটনেস পরীক্ষার উচ্চাভিলাষী চিন্তার কথা না বলতেন। সঠিক হতো, তামিম এ কথা বলে ফেলার ভুলটা করার পরও সিরিজের মধ্যে সংবাদমাধ্যমে নাজমুল হাসানের তেলেবেগুনে জ্বলে না ওঠা। শুরুতে এ নিয়ে যেহেতু খুব বেশি বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি, তিনি পারতেন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে। অথবা প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে সরাসরি তামিমের কাছেই ব্যাখ্যা চাইতে, কেন সিরিজ শুরুর আগের দিন এমন বেফাঁস কথা বললেন।
সঠিক হতো, যদি নাজমুল হাসানের আক্রমণাত্মক সমালোচনায় ক্ষুব্ধ, আবেগতাড়িত হয়ে প্রথম ওয়ানডের পরদিন সংবাদ সম্মেলন ডেকে তামিম অবসরের ঘোষণা দিয়ে না দিতেন। মনে বেশি আঘাত পেয়ে থাকলে তিনিও পারতেন বিসিবি সভাপতিকে একটা ফোন দিয়ে জানতে চাইতে, এভাবে তিনি কেন কথাগুলো বললেন? অথবা বিসিবি সভাপতির এমন আচরণে যেহেতু তামিমরা অভ্যস্ত এবং যেহেতু অতীতেও বহুবার তিনি স্পর্শকাতর সময়ে বোমা ফাটিয়ে পরে চুপসে গেছেন, তামিম পারতেন এবারের ঘটনাটিকেও পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে যেতে; সিরিজের পর এ নিয়ে কথা বলতে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, পুরো ঘটনাপ্রবাহের কোনো একটা ধাপে সঠিক কাজটি দুজনের কেউই করেননি। অথচ তাঁদের একজন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ অভিভাবক এবং অন্যজন ওয়ানডে দলের।
এ–জাতীয় সমস্যায় সংলাপ পরিস্থিতি অনেক হালকা করে দেয়। অথচ কী এক অজানা কারণে তাঁরা সেটি না করে নিজেদের মধ্য একটি ইচ্ছাকৃত ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ তৈরি করলেন। তাতে বিষয়টা এমন এক জায়গায় চলে গেল যে প্রধানমন্ত্রীকে বিচার বসাতে হলো। মজার ব্যাপার হলো, সে বিচারে যা হলো, তা কিন্তু সংলাপই, যেটা এর আগে নিজেরা করে নিলেই তামিমের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ‘অবসর–নাটক’-এর মতো একটি বিতর্কিত অধ্যায় যোগ হয় না।
ও হ্যাঁ, বিসিবি তামিমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটা সর্বনাশ ঘটে যাওয়ার পর। অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া তামিমের তখন তাদের ফোন না ধরাটাই তো স্বাভাবিক! এতটা এগিয়ে গিয়ে ‘ইগো’র প্রতিযোগিতায় কেন তিনি হারতে চাইবেন?
বাংলাদেশের ক্রিকেটে দিনে দিনে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব এমন প্রকট হয়ে ওঠাতেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মানুষটিকে মাঠের ঝগড়া মেটাতে ‘আম্পায়ার’–এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মেনে খেলার লোকেরা আবার মাঠে ফিরে আসার ঘোষণা দিলেন। অথচ এমন তো নয় যে তিনি তাঁদের যা বুঝিয়েছেন, সেটা তাঁরা আগে বুঝতে পারেননি বা জানতেন না।
ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে যে খেলোয়াড়ি মনোভাব জাগ্রত করে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে বিষয়টার সুন্দর সুরাহা করে দিলেন, এই মনোভাব কেন মাঠের মানুষদের থাকে না, সেটাই প্রশ্ন।
প্রশ্নের পিঠে চড়ে প্রশ্ন আসে। বিবাদ ভুলে তামিম তো অবসর প্রত্যাহার করে নিলেন, গণভবনের সামনে বিসিবি সভাপতির আবেগতাড়িত হাস্যোজ্জ্বল উচ্চারণ, ‘আমাদের অধিনায়ক ছাড়া আমরা খেলব কী করে!’ কিন্তু দূর কিংবা অদূর ভবিষ্যতে আবার কখনো খেলার মাঠে বেঠিক কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি তাতে তৈরি হলো?
কারণ, মাঠের খেলাটা ছাড়া খেলার আর সবকিছুতেই এখানে অখেলোয়াড়োচিত মনোভাব আর ‘ইগো’র লড়াইয়ের বড় বেশি উপস্থিতি। সব সময় প্রকাশ্যে না এলেও গোপনে তা লালিত হয় খেলার মানুষদের মধ্যেই। ‘অনুকূল’ পরিবেশে সেটা যখন ফুঁসে ওঠে, তখনই দরকার পড়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপের।
আর তাতে প্রমাণিত হয়ে যায় যে খেলার মানুষেরা তাঁদের কাজ ঠিকঠাক করতে পারছেন না। যাঁর যাঁর দায়িত্ব পালনে তাঁরা ব্যর্থ। এ রকম উদাহরণ বাংলাদেশের ক্রিকেটে অতীতেও দেখা গেছে, এবারও দেখা গেল এবং এভাবেই চলতে থাকলে ভবিষ্যতেও দেখার ‘আশা’ করা যায়।
গত মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চট্টগ্রাম-ঢাকা মিলিয়ে যা যা ঘটে গেল, তার মধ্যে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান প্রথম ওয়ানডেটা যেন অতি ক্ষুদ্র একটা অংশেই পরিণত হয়েছে। ক্রিকেট সিরিজ না বলে এটাকে ‘ড্রামা সিরিজ’ বলাই ভালো।
আর সেই সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান নয়, অন্তঃকলহ, যার আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছিল প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের অবিমৃশ্যকারী ব্যাটিং এবং ১৭ রানে হারের লজ্জা। ক্রিকেট খেলাটা এখানে অতি গৌণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে হয়তো চেষ্টা করে গেছেন দলের চিন্তাটা খেলার মধ্যে রাখতে, কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব হয়েছে কে জানে!
পুনশ্চের মতো বলে দেওয়া ভালো, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আজ সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে, বাংলাদেশের বাঁচা-মরার লড়াই। প্রথম ম্যাচে হেরে থাকায় এই ম্যাচে হারা মানে বাংলাদেশের সিরিজ হার। অথচ বাকি দুই ম্যাচের জন্য ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক লিটন দাসের গতকালের সংবাদ সম্মেলনের প্রায় পুরোটাই হলো তামিমের অবসর–বিতর্ক নিয়ে। একপর্যায়ে এক প্রশ্নকর্তাকে বিরক্ত হয়ে লিটন এ-ও বলতে বাধ্য হলেন, ‘ভাই, আমি আগামীকালের (আজ) ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আপনি যদি তামিমকে নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন, তাহলে আমার চেয়ে এখানে বোর্ড প্রেসিডেন্টের থাকাটাই ভালো, আমি চলে যাই।’
লিটনের সংবাদ সম্মেলনে পরে ক্রিকেটীয় আবহ ফিরেছে। তামিম এই সিরিজে আর না খেললেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাঁর অবসর প্রত্যাহার আপাতত স্বস্তি ফিরিয়েছে দেশের ক্রিকেটেও।
‘আপাতত’ শব্দটা রাখতেই হচ্ছে, কারণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা এই একটি সমস্যার সমাধানেই দেশের ক্রিকেট বেঠিক সংস্কৃতির চক্কর থেকে বেরিয়ে আসবে—এমন আশা করাটাও বোধ হয় এখানকার বাস্তবতায় বেঠিকের পর্যায়েই পড়বে। তার চেয়ে ও রকম নাটক ভবিষ্যতেও আরও দেখার অপেক্ষায় থাকুন।