শ্রীলঙ্কা: ৪৯.৩ ওভারে ২৭৯
বাংলাদেশ: ৪১.১ ওভারে ২৮২/৭
ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।
সাকিবকে আউট করার পর তাঁকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে বাঁ হাতের কবজিতে অদৃশ্য ঘড়ি দেখালেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। কেন, তা বুঝিয়ে বলাটা অনাবশ্যক বলে মনে হচ্ছে। যে ঘটনা নিয়ে বিশ্বকাপ তো বিশ্বকাপ, পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই তোলপাড়, তা আপনি জানেন না মনে করি কীভাবে!
টেস্ট ক্রিকেটের শুরু থেকে ধরলে ১৪৬ বছর বয়সী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এর আগে কখনো যা দেখেনি, সেটাই দেখে ফেলেছে এই ম্যাচে। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের টাইমড আউট এমনই এক বিস্ফোরণ যে তা শুধু দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বকাপেই। যেটির রেশ রয়ে গেছে ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও। নিশ্চিতভাবেই রয়ে যাবে আরও অনেক দিন। আবার যখন বাংলাদেশের দেখা হবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে, তখন তো অবশ্যই।
আন্তর্জাতিক ম্যাচে ক্রিকেটের যে আইনটা কখনো দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজন পড়েনি, সেটাই চলে এসেছে অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের ওই আউটের পর থেকেই ম্যাচটা আর নিছক ম্যাচ থাকল না। হয়ে গেল ‘যুদ্ধ’। এমন ঝাঁজালো, এমন তিক্ত, এমন শারীরিক সংঘর্ষে রূপ নিতে যাওয়া ম্যাচ বিশ্বকাপ ক্রিকেটই আর দেখেছে কি না সন্দেহ। যুদ্ধ ছাড়া আর কী!
টানা ছয় ম্যাচের হারের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকা বাংলাদেশ বিশ্বকাপেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম জয়ে উঠে গেছে পয়েন্ট তালিকার ৭ নম্বরে। সেই তৃপ্তি মুখে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে সাকিব আল হাসানও যুদ্ধের উপমাই টেনে আনলেন। যা করেছেন, তা নিয়ে তাঁর কোনো অনুতাপ নেই। আইনে আছে, তো সমস্যা কী?
আইনে তো আছেই। যদিও সাকিবের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস দাবি করলেন, হেলমেটের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার পরও তাঁর হাতে ৫ সেকেন্ড সময় ছিল। সাকিব এবং বাংলাদেশ যা করেছে, সেটি রীতমতো লজ্জাজনক। সব দলই জিততে চায়, কিন্তু জেতার জন্য কেউ এতটা নিচুতে নামতে পারে, এটা তিনি ভাবতেই পারছেন না।
ম্যাথুসের দাবি সত্যি হলে সাকিবের চেয়েও বেশি দোষ তো আম্পায়ারদের। ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর খেলার জন্য প্রস্তুত হতে নির্ধারিত ২ মিনিট পেরিয়ে না গেলে আম্পায়াররা তাঁকে কেন আউট দিলেন? বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলাটায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার যে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন ম্যাথুস, নিশ্চিতভাবেই সেই অভিযোগে ম্যাচ রেফারির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তাঁকে।
ম্যাচটাকে যুদ্ধ বলছিলাম। ম্যাচ শেষে সাকিব নিজেও তো তা-ই বললেন, ‘ম্যাচটা আমাদের জিততেই হতো। এটা যুদ্ধ। আর যুদ্ধে দলকে, দেশকে জেতানোর জন্য আপনি তো সবকিছুই করবেন, তাই না?’
এই ম্যাচের আগে ক্রিকেটীয় আলোচনাকে আড়ালে ঠেলে দিয়েছিল দিল্লির বায়ুদূষণ বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া। ম্যাচ হবে কি হবে না, এই আলোচনাও হয়েছে। অথচ ম্যাচ শুরু হওয়ার পর এ নিয়ে কথা নেই। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর তো আরও নয়। স্বাভাবিক একটা ম্যাচ হলে ম্যাচ শেষে নির্ঘাত ওটাই হতো মূল আলোচ্য। খেলতে সমস্যা হলো কি না, দৌড়াতে কি হাসফাঁস লাগছিল, ইনহেলার কি নিতে হয়েছে কারও...এসব কথা আর উঠলই না। বিকেল সোয়া চারটার দিকে দিল্লিকে নাড়িয়ে দেওয়া ভূমিকম্পের মতো অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের টাইমড আউট হওয়ার তুমুল ঝাঁকুনিতে যে তুচ্ছ হয়ে গেছে বাকি সবকিছুই।
বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জিতেছে, সেটিও ৫৩ বল বাকি রেখেই। এতেও অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না, ম্যাচটা কেমন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে একটু পরপরই। এই ম্যাচের আগে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশই একমাত্র দল হয়ে ছিল, যাদের কোনো শতরানের জু্টি নেই। নাজমুল হাসান ও সাকিব আল হাসানের ১৪৯ বলে ১৬৯ রানের তৃতীয় উইকেট জুটি শুধু সেই ব্যর্থতার গল্পে ইতিই টানেনি, ম্যাচটাকেও একপেশে বানিয়ে ফেলেছিল প্রায়। সেখান থেকে তা আবার অনিশ্চয়তায় দোলাচলে নিয়ে যাওয়ার নায়কও এই ম্যাচের কেন্দ্রীয় চরিত্র। পরপর দুই ওভারে সাকিব আর নাজমুলকে ফিরিয়ে শ্রীলঙ্কাকে ম্যাচেও ফিরিয়ে এনেছিলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস।
ম্যাচটা ম্যাথুস বনাম সাকিব হয়ে উঠেছিল আগেই। সাকিব ব্যাটিংয়ে নামার পর তো আরও বেশি। চোটজর্জর শরীর নিংড়ে দিয়ে ম্যাথুস জিততে চাইলেন এই যুদ্ধে। জিতেও গিয়েছিলেন প্রায়। শতক করে শ্রীলঙ্কাকে ২৭৯ রানে নিয়ে যাওয়া আসালাঙ্কা কভারে সাকিবের ক্যাচটা ফেলে না দিলে ম্যাচ শেষে বিজয়ী সাকিব আর বিজিত ম্যাথুসের পরিচয় বদলে যেতেও পারত। তখন মাত্র ৭ রানে থাকা সাকিব শেষ পর্যন্ত আউট হয়েছেন ৮২ রানে। আগের ৬ ইনিংসে ২৮ রান করার দুঃসহ ব্যর্থতার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে নাজমুল হাসান ৯০।
ম্যাচ শেষে এসবও আর আলোচনায় নেই। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা সোজা বেরিয়ে গেলেন মাঠ থেকে। দুই দলের খেলোয়াড়দের হাত মেলানোর চিরন্তন প্রথার তোয়াক্কা না করেই। সাকিব যেমন বলছেন, টাইমড আউট করা নিয়ে তাঁর কোনো অনুতাপ নেই, হাত না মেলানো নিয়ে ম্যাথুসও একই রকম ঝাঁজালো। যারা অন্যকে সম্মান করতে জানে না, তাদেরকে সম্মান করার প্রশ্নই ওঠে না।
বলছিলাম না, এটা ক্রিকেট ম্যাচ নয়। এটা ছিল যুদ্ধ।