কলম্বো স্ট্রিটে চলছিল ফেস্টিভ্যাল। তার একটি মুহূর্ত
কলম্বো স্ট্রিটে চলছিল ফেস্টিভ্যাল। তার একটি মুহূর্ত

‘পবিত্র দাঁত’–এর শহরে ক্রিকেট কি পেছনে

ক্যান্ডিতে এসেই যা দেখে ফেললাম, তাতে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে শুরু করেছি।

শহরটাতে তিন রাতের জন্য এসে প্রথম রাতেই দেখলাম এমন কিছু, যার জন্য এই শহর তো বটেই, শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষই সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে। আগে থেকে ট্রাভেল প্ল্যান করে দূর দেশের মানুষও ক্যান্ডিতে আসার জন্য বছরের এই সময়টাকেই বেছে নেয়। সময়টা হলো, জুলাই-আগস্ট।

আমার সে রকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমি এখানে তিন রাতের অতিথি হয়ে এসেছি এশিয়া কাপে আগামীকালের বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ কাভার করতে। এরপরই গন্তব্য লাহোর। কিন্তু প্রথম রাতই ক্যান্ডি যে চমক উপহার দিল, তাতে খেলা কাভারের সঙ্গে ফ্রি একটা ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উৎসবও কাভার করার দুর্লভ সুযোগ হয়ে গেল!

কাল বিকেলে কলম্বোতে নামার পর থেকে শুনছি, ক্যান্ডির সিটি সেন্টারের যে এলাকায় আমার হোটেল, মানে কলম্বো স্ট্রিট; সেখানে এখন একটা ফেস্টিভ্যাল চলছে। বন্দরনায়েকে এয়ারপোর্টে যে ট্রাভেল এজেন্টের কাছ থেকে গাড়ি নিলাম, তিনিও কালো টয়োটা প্রিয়াসে তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘ওখানে কিন্তু ফ্যাস্টিভ্যাল হচ্ছে। হোটেলের দিকে রাস্তা বন্ধ থাকতে পারে। তখন কিন্তু একটু আগে গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।’

শ্রীলঙ্কার মানুষ সারা বছর এই উৎসবের অপেক্ষায় থাকেন

সতর্কতা শুনেও খুব যে সতর্ক হলাম, তা নয়। ভাবটা এমন, কত দূরেই–বা আর নামিয়ে দিবে! ওটুকু পথ না হয় হেঁটেই মেরে দিব। আর যতটা বলছে, ততটা হয়তো নয়। এ নিয়ে এখনই অত ভাবনার কি আছে! গিয়েই দেখা যাক না, ঘটনা কী।

এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গাড়িতে কলম্বো টু ক্যান্ডি মসৃণ যাত্রা উপভোগ্য করে তুলল বৃষ্টি। পথে পথে থামি, চা-কফি খাই। আবার যাই। এই করে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা চার ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, তবু ক্লান্তি আসে না।

গাড়ির মালিক কাম চালক নালিন্দা প্রেমাকুমারা মিষ্টভাষী বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যেখানে বলি সেখানেই ব্রেক। তবে মাঝেমধ্যে তাঁর মুখেও শুনছি ‘ফেস্টিভ্যাল’ শব্দটা, উৎসবের ভিড় এড়িয়ে কোন দিক দিয়ে গাড়ি নিলে হোটেল পর্যন্ত যাওয়া যাবে, সে হিসাব-নিকাশ। আমি তবু ভাবি, ধুর… একটা না একটা ব্যবস্থা তো হবেই।

গাড়ি ক্যান্ডি শহরে ঢোকার পর থেকে বুঝতে শুরু করলাম, সতর্কবার্তায় গুরুত্ব না দেওয়া মস্ত ভুল হয়েছে। প্রেমাকুমারা যেদিক দিয়েই গাড়ি নিতে চান, হাত তুলে পুলিশের বাধা। দুর্বোধ্য সিংহলিজ ভাষায় প্রেমাকুমারা বনাম বিভিন্ন পুলিশের কথোপকথন শুনছি। এই ভাষা অনুবাদের ক্ষমতা আমার নেই। তবে বুঝে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল না, প্রেমাকুমারা পুলিশকে অনুনয়–বিননয় করে বলছেন, গাড়িতে বিদেশি অতিথি। সামনেই তাঁদের হোটেল। লাগেজ-টাগেজ নিয়ে ভিড় ঠেলে হেঁটে যেতে পারবেন না। একটু যদি যেতে দেন…।

কোনো পুলিশ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে শেষে বলছেন, ‘হবে না। হবে না। দেখছেন না ওয়ান ওয়ে রাস্তা!’ কেউ বলছেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার পর আসুন। তার আগে ফেস্টিভ্যাল শেষ হবে না।’ প্রেমাকুমারার মুখে ছায়া নেমে আসে।

উৎসবে সুসজ্জিত এক বিশাল হাতি নিয়ে আসা হয়েছে

আমরাও যত সময় যায়, অস্থির হয়ে উঠি। ক্লান্তি বাড়ে। অসহায় লাগে। এ কেমন উৎসব যে হোটেলের দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটার পর একটা চক্কর দিতে থাকব, কিন্তু হোটেলে যেতে পারব না! হোটেলের এত কাছেও আমরা গেছি যে ভিড় ঠেলে হেঁটে হেঁটেও চলে যাওয়া যেত।

কিন্তু ২০ থেকে ২১ দিনের সফরে লাগেজটা তো আর ছোট হয় না। তারওপর কলম্বো থেকে আমাদেরই নিয়ে আসা বৃষ্টি ঝরছে। সফরের প্রথম দিনে কিছু জটিলতা থাকেই। তাই বলে এতটা যে একটা শহরে এসে চার ঘণ্টা হয়ে যাওয়ার পরও হোটেলের দেখা পাব না!

শেষমেশ কাছের এক কেএফসিতে গিয়ে ডিনারের নামে সময়ক্ষেপণের সিদ্ধান্ত নিতে হলো। উৎসব নিশ্চয় রাতভর চলবে না। এই ফাঁকে না হয় পেটে একটু চিকেন-টিকেন পড়ুক।

ডিনার শেষ হয়ে যায়, উৎসব তো শেষ হয় না। রাত বেজে গেছে ১১টা। ঢাকা টু কলম্বো সোয়া তিন ঘণ্টার ফ্লাইট, বৃষ্টির মধ্যেও কলম্বো টু ক্যান্ডি চার-সাড়ে চার ঘণ্টা লেগেছে। অথচ হোটেলের এত কাছে এসেও চার ঘণ্টা ধরে শুধু ঘুরপাকই খাচ্ছি। মনে মনে প্রেমাকুমারাকে পৃথিবীর সেরা মানুষদের একজন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ফেললাম তখনই।

এই লোক আমাদের পৌঁছে দিয়ে রাতেই আবার কলম্বো ফিরবেন। তিনি পারতেন এত ঝামেলায় না জড়িয়ে আমাদের কোনো একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে বলতে, ‘অনেক হয়েছে। এবার তোমরা তোমাদের পথ ধর।’

প্রেমাকুমারা সেটা না করে আমাদের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াটাকে তাঁর দায়িত্ব মনে করলেন। একটু একটু করে ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কেও ধারণা দিতে লাগলেন। প্রতিবছর জুলাই-আগস্টের কোনো একটা সময় স্থানীয় টুথ টেম্পলকে ঘিরে এই উৎসব চলে ১০ দিন। এবার যেমন হচ্ছে ২১ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

উৎসবের সময় এই এলাকার পরিস্থিতি এরকমই থাকে। সমস্যা হলো আমাদের আসার উপলক্ষটাও পড়ে গেছে এই সময়। আর নিয়েছিও ঠিক কলম্বো স্ট্রিটেরই এক হোটেল, যেখানে এখন এই রাত আড়াইটার সময়ও রুম থেকে ঢোল-বাদ্যের শব্দ শুনছি।

ঘণ্টাখানেক আগে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম একটা র‍্যালি। ব্যান্ডপার্টি বাজনা বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। তাদের পেছনে সুসজ্জিত এক বিশাল হাতি। হাতির গায়ে লাল পোশাক। সেই পোশাকে আবার ঝিকিমিকি বাতি জ্বলছে। ঐতিহ্যবাহী ‘এসালা পেরাহেরা ফেস্টিভ্যাল’ মানেই আলো ঝলমলে ১০টি রাত।

সন্ধ্যায় একবার প্রেমাকুমারাও আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে উৎসবের বেশ কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। উৎসব বলতে ওই র‍্যালিই, যেটা এই ১০ দিনের প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর শুরু হয়ে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত চলছে।

উৎসব ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে

মশাল জ্বালিয়ে করা র‍্যালিতে সুসজ্জিত হাতি থাকে, বাদ্যের তালে তালে স্থানীয় নাচ-গান হয়। হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসে উৎসব। তাদের নিয়ে আসা বাস-গাড়িতে তীব্র যানজট, জায়গায় জায়গায় পুলিশের কড়া পাহারা, ব্যারিকেড এবং প্রচুর বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতি বলে দেয় এ উৎসব আসলেই বিশেষ কিছু। এখানে আসা লোকজনও এসবকে কোনো সমস্যা মনে করছেন বলে মনে হয়নি। বৃষ্টিতে ভিজেই সবাই বিপুল উৎসাহে ফেস্টিভ্যাল দেখছেন, ছবি তুলছেন। রাতের বেলায়ও অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা এসেছে ইউনিফর্ম পরে।

প্রেমাকুমারাও বারবার এমন কিছুই বোঝাতে চাচ্ছিলেন। তাঁর কথা শুনে আর গাড়িতে বসে ইন্টারনেট ঘেঁটে যা পেলাম, তাতে উৎসবের গুরুত্ব সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণাও জন্মে গেল।

উৎসবের নাম ‘এসালা পেরাহেরা ফেস্টিভ্যাল।’ বলা হয়ে থাকে, এটাই সম্ভবত সারা বিশ্বে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সর্ববৃহৎ উদ্‌যাপন। টুথ টেম্পলে গৌতম বুদ্ধের দাঁতের কিছু অংশ রাখা আছে। এটা মূলত ‘সেকরেড টুথ টেম্পল রিলিক’ বা পবিত্র দাঁতের অবশিষ্টাংশের মন্দির নামে পরিচিত। স্থানীয় রাজনীতিতেও এর নাকি বড় ভূমিকা।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ক্যান্ডিতে আগামীকাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলবেন মুশফিক–মিরাজরা

‘এসালা পেরাহেরা ফেস্টিভ্যাল’ যে সময়টাতে হয়, মনে করা হয়, অহিংসার ধর্ম প্রচারে গৌতম বুদ্ধ তাঁর প্রথম বাণীটা এই সময়েই দিয়েছিলেন। এবার একই সময়ে পড়ে গেছে এশিয়া কাপ ক্রিকেট এবং সেই ম্যাচও দিবা-রাত্রির। পাল্লেক্কেলের মাঠে যখন ফ্লাড লাইট জ্বলবে, কলম্বো স্ট্রিটে জ্বলবে উৎসবের মশাল।

বাংলাদেশ-শ্রীলংকা খেলার দিন, মানে কাল ৩১ আগস্ট ‘এসালা পেরাহেরা ফেস্টিভ্যালের’ ও শেষ দিন। দেখাই যাক, ক্যান্ডির মানুষকে কোনটি বেশি টানে—খেলা, নাকি উৎসব?