চতুর্থ উইকেটে ১০২ রানের জুটি গড়েন ওয়ার্নার–স্টয়নিস
চতুর্থ উইকেটে ১০২ রানের জুটি গড়েন ওয়ার্নার–স্টয়নিস

ওয়ার্নারের রেকর্ড, স্টয়নিসের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে জয়ে শুরু অস্ট্রেলিয়ার

ডেভিড ওয়ার্নার ৩১২০ রানে পৌঁছাতেই টিভি পর্দায় দেখানো হলো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এককভাবে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হতে তাঁর আর ১ রান দরকার। তা দেখে ধারাভাষ্যকক্ষের শীতল হাওয়ায় বসে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন অ্যারন ফিঞ্চ। ওয়ার্নার তখন যাঁর সঙ্গে যৌথভাবে শীর্ষ রান সংগ্রাহক, তিনি তো ফিঞ্চই।

অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ফিঞ্চ ছিলেন ওয়ার্নারের দীর্ঘদিনের উদ্বোধনী সঙ্গী। দুই বল পর ওয়ার্নার সিঙ্গেল নিতেই করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন ফিঞ্চ। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচিয়ে সাড়া দিলেন ওয়ার্নারও। বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে ওমানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে খুব সম্ভবত এটিই সেরা মুহূর্ত।

প্রথমবারের মতো ২০ দলের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেশ কয়েকটি অসম লড়াই দেখা যাবে, তা জানা কথা। সেসব লড়াইয়ের একটি এই অস্ট্রেলিয়া-ওমান ম্যাচ। ওয়ার্নারের ফিঞ্চকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দিনে মার্কাস স্টয়নিস ব্যাট-বলে দারুণ অবদান রাখলেন। তাতে প্রত্যাশিতভাবেই জিতল অস্ট্রেলিয়া, ব্যবধানটা ৩৯ রানের।

জয় দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করা অস্ট্রেলিয়া নামিবিয়াকে সরিয়ে ‘বি’ গ্রুপের শীর্ষেও উঠে গেল। আর নামিবিয়ার বিপক্ষে সুপার ওভারে হারের পর অস্ট্রেলিয়ার কাছেও বড় ব্যবধানে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়া একরকম নিশ্চিত হয়ে গেল ওমানের।  

ওয়ার্নার এখন অস্ট্রেলিয়ার টি–টোয়েন্টি ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক, স্বীকৃত টি–টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি ফিফটিও এখন তাঁর

এই ম্যাচের আগে অস্ট্রেলিয়া-ওমান কখনোই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুখোমুখি হয়নি। তবে দুই দলের শক্তিমত্তা-সামর্থ্য-ইতিহাস বিবেচনায় নিলেই আজকের ম্যাচের ফল অনুমান করা যাচ্ছিল। কিন্তু ম্যাচটা যতটা একপেশে হবে বলে ভাবা হচ্ছিল, ততটা একপেশে হয়নি। এবারের বিশ্বকাপে জটিল-দুর্বোধ্য পিচে লো স্কোরিং ম্যাচ যেভাবে ‘ট্রেন্ড’ হয়ে উঠেছে, টস জিতে অস্ট্রেলিয়াকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠানো ওমান ৯ ওভারের মধ্যে ৫০ রানে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে আরেকটি রানখরার ম্যাচের আভাস দিয়েছিল।

আইপিএলে পাওয়ারপ্লেতে চার-ছক্কার ফুলঝুরি বিছানো ট্রাভিস হেডকে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উইকেট পতনের শুরু। ১০ বলে ২ চারে ১২ রানের বেশি করতে পারেননি হেড। তিনে নামা অধিনায়ক মার্শও মন্থর উইকেটে হাত খুলে খেলতে পারেননি। থিতু হওয়ার পর যখনই মেরে খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনই মেহরান খানের বলে শোয়েব খানের হাতে ধরা পড়লেন।

পরের বলে মেহরান তো আরও বড় চমক দিলেন। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের কপালে জুটল ‘গোল্ডেন ডাক’। আইপিএলে কাটানো দুঃসময়টা বোধ হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও বয়ে এনেছেন ম্যাক্সওয়েল। নয়তো এত ভালো ড্রাইভ করেও ওমান অধিনায়ক আকিব ইলিয়াসের অমন দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত হবেন কেন! ইলিয়াসের ক্যাচটিকে তো এবারের আসরে এখন পর্যন্ত সেরা ক্যাচ বলা হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ার ঘুরের দাঁড়ানোর শুরু এরপরই। অভিজ্ঞতা কেন অমূল্য অর্জন, তা আবারও প্রমাণ করলেন ওয়ার্নার। মার্কাস স্টয়নিসকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। নিজে এক প্রান্তে ভরসা হয়ে রইলেন আর স্টয়নিস মারমুখী হলেন। একপর্যায়ে দুজনই তুলে নিলেন ফিফটি।

ওমানের এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি

৫৬ রানের ইনিংস খেলার পথে ওয়ার্নারের ফিফটি আরেক রেকর্ড হয়ে রইল। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি এটি তাঁর ১১১তম ফিফটি, যা কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ। এত দিন ক্রিস গেইলের সঙ্গে ১১০ ফিফটি নিয়ে যৌথভাবে শীর্ষে ছিলেন ওয়ার্নার।

শুধু কি তা-ই? চতুর্থ উইকেটে স্টয়নিসের সঙ্গে ওয়ার্নারের গড়া ১০২ রানের জুটিটাও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। চতুর্থ উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ ১৬১ রানের জুটিতেও জড়িয়ে আছে ওয়ার্নারের নাম। ২০১৬ সালে জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে গড়েছিলেন সেই জুটি।

ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে হাস্যোজ্জ্বল মার্কাস স্টয়নিস

প্রথম ১০ ওভার শেষে মাত্র ৫৬ রান তুলতে পারা অস্ট্রেলিয়া শেষ ১০ ওভারে ১০৮ রান নিতে পেরেছে ওয়ার্নার-স্টয়নিস জুটির কারণেই। শেষ দিকে টিম ডেভিডের ৪ বলে ৯ রানের ‘ক্যামিও’ও তাতে সহায়তা করেছে। ইনিংসের দৃশ্যপট পাল্টে দিতে হলে নির্দিষ্ট কাউকে ‘টার্গেট’ করতে হয়। স্টয়নিসের আজকের টার্গেট ছিলেন এক ওভারে জোড়া শিকার করা মেহরান। ১৫তম ওভারটি ছিল তাঁর বোলিং কোটা পূরণের। সেই ওভারে ৪ ছক্কা আর একটি ডাবলসে একাই ২৬ রান নিয়েছেন স্টয়নিস। এতেই ঘুরে যায় ম্যাচের মোড়।  

১৬৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা ওমানের ‘অ্যাপ্রোচ’ দেখে কখনোই মনে হয়নি জয়ের জন্য খেলছে। মিচেল স্টার্ক-মার্কাস স্টয়নিস-নাথান এলিসের তোপে মধ্যপ্রাচ্যের দলটি শুরু থেকেই ভুগেছে। মাঝের ওভারগুলোয় ওমানের ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। ব্যাট হাতে ৬৭ রানে অপরাজিত থাকা স্টয়নিস বল হাতেও সবচেয়ে সফল, ১৯ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট। স্টার্ক, জাম্পা ও এলিসের শিকার ২টি করে।

এমন পিচ থেকে এলিস নিজের সেরাটা আদায় করে নিতে পারেন—এই বিশ্বাসে তাঁকে একাদশে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক টেস্ট অধিনায়ক টিম পেইন। টিম ম্যানেজমেন্ট এলিসকে খেলিয়েছেও।

এলিসকে একাদশে রাখতে যাঁকে বাদ পড়তে হয়েছে, তাঁর নামটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন—প্যাট কামিন্স, যাঁর নেতৃত্বে গত বছর সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্ডিশন ও দলীয় সমন্বয়ের কথা চিন্তা করেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) হয়তো কামিন্সের জায়গায় মার্শকে নেতৃত্বভার তুলে দিয়েছে। এতে এটাও নিশ্চিত হয়েছে, অধিনায়ক হিসেবে ‘ক্যাপ্টেনসি কোটা’য় অটো চয়েস যেন না হয়ে যান কামিন্স।

প্যাট কামিন্সকে একাদশে রাখেনি অস্ট্রেলিয়া

তিন সংস্করণ মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এখন পর্যন্ত ২০২টি ম্যাচ খেলেছেন কামিন্স। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে কখনোই খেলা হয়নি তাঁর। খেলার সুযোগ পেলেন না আজও। তাঁর এই ত্যাগ স্বীকার নিশ্চয় দলের ভালোর জন্যই।

অস্ট্রেলিয়া এমনটা করতে পারে বলেই তো তারা অস্ট্রেলিয়া!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

অস্ট্রেলিয়া: ২০ ওভারে ১৬৪/৫
(স্টয়নিস ৬৭*, ওয়ার্নার ৫৬, মার্শ ১৪, হেড ১২, ডেভিড ৯, ম্যাক্সওয়েল ০; মেহরান ২/৩৮, কলিমউল্লাহ ১/৩০, বিলাল ১/৩৬)।

ওমান: ২০ ওভারে ১২৫/৯
(আইয়ান ৩৬, মেহরান ২৭, ইলিয়াস ১৮, শাকিল ১১; স্টয়নিস ৩/১৯, স্টার্ক ২/২০, অ্যাডাম জাম্পা ২/২৪, নাথান এলিস ২/২৮)।

ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩৯ রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মার্কাস স্টয়নিস (অস্ট্রেলিয়া)।