গতকাল শ্রীলঙ্কা–ইংল্যান্ড ম্যাচেও একপেশে লড়াই দেখা গেল। শ্রীলঙ্কার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ইংল্যান্ড
গতকাল শ্রীলঙ্কা–ইংল্যান্ড ম্যাচেও একপেশে লড়াই দেখা গেল। শ্রীলঙ্কার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ইংল্যান্ড

এমন একপেশে ম্যাচের বিশ্বকাপ কি কেউ দেখেছে আগে

বিশ্বকাপ জমিয়ে তুলতে নাকি অঘটন লাগে। তা অঘটন তো ভালোই হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিয়েছে নেদারল্যান্ডস। আফগানিস্তান শুধু বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হারিয়েই থামেনি। মাঝখানে এক ম্যাচ হারার পরই আবার হারিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানকেও। এখন শ্রীলঙ্কাকেও হারিয়ে এখন স্বপ্ন দেখছে অঘটনের তৃতীয় খণ্ড লেখার।

ইংল্যান্ড আর পাকিস্তানের অবস্থা নাহয় এর আগে থেকেই একটু খারাপ ছিল, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা? নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে বসার আগে ও পরে তারা এমন খেলছে যে ওই ম্যাচের ফলটা এখনো একটু বিস্ময় জাগিয়েই যাচ্ছে।

এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিস্ময় অবশ্য এটা নয়। সেটি কী? অবশ্যই ২৫ ম্যাচ শেষেও শ্বাসরোধী উত্তেজনার একটি ম্যাচেরও দেখা না পাওয়া। যে অঘটন তিনটির কথা বললাম, সেই তিনটিতেও তো জয়-পরাজয় নিয়ে সংশয় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ওভার-নির্দিষ্ট খেলার মূল যে আকর্ষণ, সেই নখ কামড়ানো উত্তেজনা কই?

কাল রাতে বিশ্বকাপের সর্বশেষ ম্যাচটার কথাই ধরুন। ম্যাচের দুই দল ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা কারও অবস্থাই খুব একটা সুবিধার ছিল না। চার ম্যাচে দুই দলেরই মাত্র একটি করে জয়। দুই দলের জন্যই জীবন-মরণ লড়াই। এমন একটা ম্যাচ তো না জমে পারেই না। অথচ কী হলো! শ্রীলঙ্কা ৮ উইকেটে জিতে গেল, সেটিও ১৪৬ বল বাকি থাকতেই।

শ্রীলঙ্কার কাছে হারে হতাশ ইংলিশ ক্রিকেটাররা

এটাই এখন এই বিশ্বকাপের ট্রেডমার্ক বলে মনে হচ্ছে। একের পর এক একপেশে ম্যাচ। শ্রীলঙ্কা যেহেতু ৮ উইকেটে জিতেছে, উইকেটে জেতার হিসাবটাই আগে দিয়ে নিই। ৮ উইকেটে জয় আছে সবচেয়ে বেশি, ৪টি। ৭ উইকেটে ২টি, ৬ উইকেটে ৩টি। এত বিস্তারিত না বলে শুধু এটা জানিয়ে দিই, উইকেটের হিসাবে এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম ব্যবধানের জয়টি ৪ উইকেটে। কী বুঝলেন?

রানের হিসাবে জয়-পরাজয়ের হিসাব যদি করেন, সেখানেও অবস্থাটা একই রকম। এই বিশ্বকাপে ১০০ রানের বেশি ব্যবধানে জয় ৫টি। ২০০ রানের বেশি ব্যবধানে ১টি। গত পরশু অস্ট্রেলিয়া-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে তো দুই দলের ব্যবধান ছিল ৩০৯ রানের!

রানের হিসাবে সবচেয়ে কম ব্যবধানের জয়টাও এবার ৩৮ রানের। যদিও এখানে একটা টীকা লাগছে। এটা দক্ষিণ আফ্রিকা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ। বৃষ্টির কারণে যেটি পরিণত হয়েছিল ৪৩ ওভারের ম্যাচে। তা ৪৩ ওভারের ম্যাচে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান ৩৮ রান হলে সেটিকে কি আর খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ বলা যায়!

দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পথে ম্যাচসেরা ডাচ অধিনায়ক অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস

তেমন ম্যাচ আসলে একটাও হয়নি এবারের বিশ্বকাপে। সংক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া ওই ম্যাচটাকে যদি বাইরে রাখেন, পুরো ৫০ ওভার হয়েছে, এমন ম্যাচে জয়-পরাজয়ের ন্যূনতম ব্যবধান ৬২ রানের। হিসাব করার পর একটু অবিশ্বাস্যই লাগছে যে রানের হিসাবে যে ১২টি ম্যাচে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র পাঁচটিই ১০০ রানের কমে! যদি ১২ ম্যাচের গড় করেন, তাহলে দেখা যায় জয়ী আর পরাজিত দলের মধ্যে গড় ব্যবধান ১৩০ রানের। উইকেটের ক্ষেত্রে যা ৬.৬৯।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর রিজওয়ান

নখ কামড়ানো সমাপ্তির একটা ম্যাচও হয়নি এখনো, এটা তো আগেই বলেছি। ‘খারাপ’-এর মধ্যেই যদি ভালো বাছতে হয়, তাহলে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ম্যাচ বলবেন কোনটিকে? বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের ম্যাচটাই তো অগ্রাধিকার পায়। তবে সেই ম্যাচটাই–বা সমাপ্তির বিচারে এমন কী! মাত্র ৪ উইকেট হারিয়েই তো পাকিস্তান টপকে গেছে শ্রীলঙ্কার পাহাড়প্রমাণ ৩৪৪ রান। ৬ উইকেটে জয়ও যদি ম্যাচের ম্যাড়মেড়ে সমাপ্তি বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে থাকে, তাহলে বাড়তি আরেকটা তথ্য দেওয়া যাক। এই ম্যাচটাও তো শেষ ওভারে যায়নি। শেষ হয়ে গেছে ১০ বল বাকি থাকতেই।

একের পর এক এমন একপেশে ম্যাচ বিশ্বকাপ কি এর আগে দেখেছে কখনো? এখনো যেহেতু এই বিশ্বকাপের অনেকটা পথ বাকি, ২৫ ম্যাচের শেষের হিসাবটাই করা ভালো। রান আর উইকেটে জয়-পরাজয়ের গড় ব্যবধানে ২০১১ বিশ্বকাপের প্রথম ২৫ ম্যাচও অনেকটা এমনই। তবে সেটি যখন গড় করা হবে। নইলে ২০১১ বিশ্বকাপের প্রথম ২০ ম্যাচের মধ্যেই অন্তত দুটি দর্শকের স্নায়ুর বড় পরীক্ষা নিয়েছিল। যার একটি বেঙ্গালুরুতে ভারত-ইংল্যান্ডের সেই ‘টাই’। ভারতের ৩৩৮ রানের জবাবে ইংল্যান্ডও করেছিল ৩৩৮। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখনো যা সবচেয়ে বেশি রানের ‘টাই’ হয়ে আছে।

রেকর্ডগড়া সেঞ্চুরির পর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল

অন্যটি তো বিশ্বকাপেরই অন্যতম স্মরণীয় ম্যাচ। যেটিতে ইংল্যান্ডের ৩২৭ রান টপকে আয়ারল্যান্ড পেয়েছিল স্মরণীয় এক জয়। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এই বিশ্বকাপে ৪০ বলে সেঞ্চুরি করেছেন, কিন্তু তাতে তো ম্যাচটা আরও বেশ একপেশে হয়ে গেছে।

সেদিন আয়ারল্যান্ডের কেভিন ও’ব্রায়েনের ৬৩ বলে ১১৩ রানের ইনিংসটি যেখানে উপহার দিয়েছিল রুদ্ধশ্বাস এক সমাপ্তি। আয়ারল্যান্ড জিতেছিল শেষ ওভারের প্রথম বলে। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার রেকর্ডটা তো এবারই ভাঙল। যদিও উত্তেজনার বিচারে দুটির তুলনা চলে না।

কেন এবার একের পর এক একপেশে ম্যাচ হচ্ছে, তার কোনো কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে ব্যাটিং বা পরে ব্যাটিং এসবেও কোনো ব্যাখ্যা নেই। কাল বিশ্বকাপের ২৫তম ম্যাচ হলো। বিজোড় সংখ্যার ম্যাচ বলেই আগে ব্যাটিং করে জয় আর পরে ব্যাটিং করে জয়ের মধ্যে সমতাটা নেই। নইলে প্রথম ২৪টি ম্যাচের ১২টিতে প্রথমে ব্যাটিং করা দল জিতেছে, ১২টিতে পরে ব্যাটিং করা দল। তাহলে ব্যাখ্যা কী?

ব্যাখ্যা নেই। শ্বাসরোধী উত্তেজনার একটা সমাপ্তি দেখার জন্য এই বিশ্বকাপের অপেক্ষা কবে ফুরাবে, সেই উত্তরও জানা নেই কারও।