>
এশিয়া কাপেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। সেই স্মৃতি রোমন্থন করছেন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু
সেবার শুনলাম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যারা টেস্টখেলুড়ে দেশ নয়, তাদের একটি টুর্নামেন্ট হবে। এই টুর্নামেন্টে যারা চ্যাম্পিয়ন হবে তারাই পরের এশিয়া কাপে খেলবে। ১৯৮৪ সালে সেই টুর্নামেন্ট হলো বাংলাদেশে। মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর এল। আমরা সেখানে চ্যাম্পিয়ন হলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আগেভাগেই জেনে গেলাম, দুই বছর পরের এশিয়া কাপে আমরা খেলতে যাচ্ছি।
এশিয়ার বড় দলগুলোর সঙ্গে খেলব, সেটা ভেবে খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম।
আমাদের প্রস্তুতি আসলে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে লম্বা সময় ধরে হতো না। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভালো উইকেট কখনো পাইনি। তবে প্রথম এশিয়া কাপ খেলতে যাচ্ছি, এটা ভেবে তখন ভীষণ রোমাঞ্চ কাজ করেছিল।
জানতাম, এশিয়া কাপে যাচ্ছি শুধু অংশগ্রহণ করতে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। আমাদের পেস বোলিং সামলাতে সমস্যা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, ফাস্ট বল খেলতে একটু সময় কম পাচ্ছি। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকলে এগুলো রপ্ত করা যায় না। বোলিং মেশিনের নামও সেভাবে শুনিনি। ফাস্ট উইকেট বা সবুজ উইকেটে সাইট স্ক্রিনে চোখ রেখে বোলারের মুঠোর দিকে তাকানোর অভ্যাসই ছিল না।
সে সময় লাল বলেই ৫০ ওভারের ক্রিকেট হতো। মুভমেন্ট ছিল ভয়ংকর। পিচ ঢাকা থাকত না। ব্যাটিং করা কঠিন ছিল। খুব একটা বিদেশ সফর না করায় বাইরের পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল। অবশ্য জানতাম, এসব জয়-পরাজয়ে খুব একটা ভূমিকা রাখবে না। কারণ ‘জয়’ ব্যাপারটাই আমাদের জন্য তখন ছিল অভাবিত।
প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তান। আমাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। সেই এশিয়া কাপ আর এই ম্যাচ নিয়ে ইদানীং ফেসবুকে অনেক রকম গল্প দেখি। বেশির ভাগই সত্যি নয়। যেমন প্লেনের টিকিটের টাকা ছিল না জন্য আমরা নাকি এত দীর্ঘ পথ বাসে করেই গিয়েছিলাম। দেখুন, এশিয়া কাপ সেবার শ্রীলঙ্কায় হয়েছিল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে বাসে করে যাওয়াটা কঠিন।
আমাদের সেই সময়টা অবশ্যই অনেক আবেগের, রূপকথার মতো। কিন্তু সত্যি গল্পটাই যথেষ্ট রোমাঞ্চকর, তাতে মিথ্যা আবেগের প্রলেপ দেওয়ার কী দরকার? এটি বরং সত্যিটাকেই অপমান করা।
আরও একটা কথা যেমন এখন শুনি। ইমরান খানের সঙ্গে টস করা। টসের জন্য যখন ড্রেসিংরুম থেকে হাঁটা শুরু করলাম, পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান বলেছিল, ‘মাঠে যাওয়ার দরকার কী। আমরা এখানেই টসটা সেরে নিচ্ছি না কেন?’ ইমরানের সঙ্গে টস করতে যাচ্ছি, খুবই রোমাঞ্চিত ছিলাম। তখন ম্যাচ রেফারি ছিল না। দুই অধিনায়ক যেটা মনে করে সেটাই হবে। তা ছাড়া তখন এখনকার মতো টস, পিচ রিপোর্ট এসব টিভিতে সম্প্রচারের বালাইও ছিল না। সাইডলাইনে টস করা কিংবা উইকেটে গিয়ে করার তখনকার দিনে আলাদা কোনো তাৎপর্য রাখত না। এখনকার প্রেক্ষাপটে ইমরানের কথা অন্য রকম শোনালেও তখনকার দিনে ওটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তাঁর প্রস্তাব মেনে টসটা তাই ওখানেই করে ফেললাম। তবে হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতেই হবে, বাস্তবতার কারণেই, বাকি দলগুলোর সঙ্গে আমাদের যোজন যোজন দূরত্বের কারণেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিপক্ষকে অনেক ওপরে আসন দিয়ে দিতাম। ওয়াসিম আকরামের মতো মাত্রই কমাস আগে দলে আসা তরুণ কিংবা এখনকার অনেকের কাছে অচেনা জাকির খানরাও আমাদের কাছে তখন বিরাট তারকা।
আমরা প্রথম পর্বেই বিদায় নেওয়ার পরই দেখলাম শ্রীলঙ্কারও নাকাল অবস্থা পাকিস্তানের বিপক্ষে। আধা বেলায় খেলা শেষ| তখন দেখি, ম্যাচ শেষেই শ্রীলঙ্কা চলে এসেছে অনুশীলনে। রোশান মহানামাকে দীর্ঘক্ষণ বাউন্সার দেওয়া হচ্ছে, অরবিন্দ ডি সিলভাকে পুল করানো শেখানো হচ্ছে। তখন থেকেই কিন্তু লঙ্কানদের মধ্যে ক্রিকেটটাকে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নিতে দেখেছি। বাড়তি পরিশ্রম করতে দেখেছি। যার ফলাফলও ওরা দ্রুতই পেয়েছিল, ১৯৯৬ সালেই বিশ্বকাপ!
সেবার এশিয়া কাপ শেষেও বেশ কিছুদিন আমরা ওখানে ছিলাম। শুধু ফ্লাইটের কারণে নয়। ওরা বলল, থেকে ফাইনালটা দেখো। কিছু শিখতে পারবে। ওই ফাইনালেই সেবার শ্রীলঙ্কার ভিন্ন রূপটা দেখতে পেলাম। এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানকে হারিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ দলকে বেশ আতিথ্য দেওয়া হয়েছিল। খেতে গিয়ে হোটেলের বাইরে দর্শকদের ভিড় দেখেছিলাম। যেখানেই গিয়েছি, সবাই খুব সম্মান করেছে। আমাদের ছোট দল ভাবেনি কখনো। অবজ্ঞার চোখে দেখেনি। এটা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
পরের আসর, অর্থাৎ ১৯৮৮ এশিয়া কাপের স্বাগতিক কিন্তু ছিল বাংলাদেশই। বেশ উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল। ওই সময় তো পিআইএ, এমসিসি, ওয়েস্ট বেঙ্গল—এসব দলই বাংলাদেশে বেশি আসত। ওমর কোরেশি একাদশ এলেও বেশ হইচই পড়েছিল। তবে এশিয়া কাপেই প্রথম এতগুলো জাতীয় দলের তারকাকে এত কাছ থেকে দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ।
সেবার এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ঘটা একটা মজার ঘটনা বলি। একটা ম্যাচে আকরাম খান ফিল্ডিং করছিল স্কয়ার লেগে, সীমানার কাছে। ও এসে আমাকে বলল, ওখান থেকে সরিয়ে দেন। বললাম, কেন? আকরাম লাজুক মুখে বলল, ওদিকটা নাকি নারী দশর্কদের গ্যালারি!
নিতান্তই কৌতুক করে বললাম। কিন্তু এটিও আমাদের তখনকার ক্রিকেট আর এখনকার ক্রিকেটের চিত্রটা বোঝাতে সাহায্য করবে। এখন তো আমাদের দেশে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বড় তারকা, এমনকি শোবিজ জগতের তারকাদের চেয়েও বড়।
সময়ের হাত ধরে সবকিছু এভাবেই বদলায়। এবার এশিয়া কাপও যেমন হচ্ছে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে। যদিও টি-টোয়েন্টি আমার খুব একটা ভালো লাগে না। বিনোদন দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শুদ্ধ ক্রিকেটের জন্য তা কতটা তৃপ্তিদায়ক, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে আমি ক্রিকেট রোমান্টিক হলেও গোঁড়া নই। পরিবর্তন আসবেই। শুধু আমাদের মাথায় রাখতে হবে, মূল সুর, মূল চেতনা যেন হারিয়ে না যায়।
প্রতিবার এশিয়া কাপ এলেই সেই পুরোনো গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতে হয় আমাকে। একই গল্প, বারবার বলি। কিছু কিছু গল্প হয়তো বারবার বলা আর শোনাতেও কোনো ক্লান্তি নেই। তবে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আমি খুব করেই চাইব, আমাদের ক্রিকেটগাথায় দ্রুতই একটা বড় টুর্নামেন্টের বড় ট্রফির গল্পটা যুক্ত হোক।